ছোটোবেলার কথা ভাবতে বসলে অনেক কিছুই মনে আসে। এক্কা-দোক্কা থেকে মাটির পুতুল। তবে শুধুই সেসব নয়। মনে আসে বিভূতিভূষণ, রবীন্দ্রনাথ আর সুকুমার রায়। সুকুমার রায় (Sukumar Ray) মানেই আবোল তাবোল (Abol Tabol)। পড়ার পর মনজুড়ে সারাদিন চলতে থাকা কুমড়োপটাশ, হুঁকোমুখো হ্যাংলা আর সেই হাঁসজারুকে আসলে দেখতে কেমন। আসলে গোপাল, সুবিমল আর ছোটনদের ছোটোবেলার খাদ্য মানেই সুকুমার রায়। তিনি একাধারে কবি, ছড়াকার, শিশুসাহিত্যিক, রচনাকার, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার ও সম্পাদক। তিনিই ভারতীয় সাহিত্যে ‘ননসেন্স রাইমের' প্রবর্তক। আজ এই ক্ষণজন্মা কিংবদন্তীর জন্মদিন। ১৮৮৭ সালের ৩০ অক্টোবর কলকাতায় তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন বাংলা শিশুসাহিত্যের উজ্জ্বল রত্ন উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরির ছেলে। তাঁর মায়ের নাম বিধুমুখী দেবী। তাঁর লেখা আবোল তাবোল (ননসেনশিয়াল মেমোনমিক্স, ১৯২৩) অত্যন্ত জনপ্রিয় সংকলন। আপাতদৃষ্টিতে অযৌক্তিক এবং সূক্ষ্মভাবে ব্যঙ্গাত্মক ছড়াগুলি এতটাই মৌলিক যে আপনার মনে হতে পারে তিনি এই ছড়া বাদে আর কিছুই রচনা করেননি। তিনি এখনও বাংলা সাহিত্যের অন্যতম সেরা লেখক হিসাবে বিবেচিত হন। উদ্ঘট এবং অর্থহীন ভাষা ব্যবহার করে তাঁর কাজ ওয়ান্ডারল্যান্ডের লুইস ক্যারলের এলিসের চেয়ে কম কিছু নয়। বিশেষত তাঁর নাটক হ য ব র ল।
মাত্র ৮ বছর বয়সে প্রথম কবিতা 'নদী' লেখেন সুকুমার রায়। বছর খানেকের মধ্যে লেখেন 'টিক টিক টং'। এই ছড়ার তাঁর নার্সারি স্কুলের ছড়া 'হিকরি, ডিকরি, ডক'-র বাংলা অনুবাদ। এরপর কয়েক বছর ধরে তিনি কবিতা, ছড়া, নাটক, গল্প, নিবন্ধ, গবেষণা পত্র এবং বাংলা ও ইংরেজিতে কয়েকটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। তিনি সেই সময়ের লেখার যে ধরন ছিল সেই পরম্পরা ভেঙে দিয়েছিলেন। সুকুমার রায়ের লেখাগুলি বাচ্চাদের জন্য মনে হলেও আসলে ভাষার সরলতা এবং রসিকতার অন্তর্নিহিত একটি ব্যাখ্যা এবং বিদ্রূপ রয়েছে। তিনি সাধারণ মানুষের প্রতিদিনের কাজকর্ম সম্পর্কে লিখেছেন এবং দেখিয়েছেন যে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে মানুষের মানসিকতা কীভাবে কাজ করে। তাঁর রচনাগুলি উনিশ শতকে বাংলার সুস্পষ্ট ছবি তুলে ধরেছে। মজার বিষয় হল, তিনি প্রায়ই কবিতা, ছড়া, নাটক এবং গল্পগুলিতে প্রাণীর নাম ব্যবহার করতেন। এটি তাঁর কাজকে আকর্ষণীয় এবং হাস্যকর করে তুলেছিল। তাই তিনি সেই সব কল্পানার প্রাণীকে যা ইচ্ছা তাই বলতে বাধ্য করেছিলেন। বাচ্চারাও তাঁর লেখা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন প্রাণীর সাথে আরও পরিচিত হতো। এর ফলে বাচ্চারা সহজেই কোনও প্রাণীকে চিনে যেত বা প্রাণীদের সম্পর্কে তাদের মনে ভয় জন্মাত না। আসলে সুকুমার রায়ের লেখাগুলি মানুষ ও প্রাণীদের মধ্যে ভারসাম্যের প্রচার করেছে। তাছাড়া মানুষের অনেক চারিত্রিক গুণও প্রাণীদের মধ্যে তিনি লেখার মধ্যে ফুটিয়ে তুলতেন। যেমন 'অদ্ভূত কাঁকড়া' ও 'লড়াইবাজ জানোয়ার'। আরও পড়ুন: Kali Puja 2019: কালীপুজোয় সিঁদুর খেলা! নতুন ভাবনা নিয়ে লেটেস্টলি বাংলার মুখোমুখি নিউ বারাকপুরের নব বারাকপুর যাত্রিক ক্লাব
সুকুমার রায় জন্মেছিলেন বাঙালি নবজাগরণের স্বর্ণযুগে। তার পারিবারিক পরিবেশ ছিল সাহিত্যানুরাগী, যা তার মধ্যকার সাহিত্যিক প্রতিভা বিকাশে সহায়ক হয়। পিতা উপেন্দ্রকিশোর ছিলেন শিশুতোষ গল্প ও জনপ্রিয়-বিজ্ঞান লেখক, চিত্রশিল্পী, সুরকার ও শখের জ্যোতির্বিদ। উপেন্দ্রকিশোরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, যিনি সুকুমারকে সরাসরি প্রভাবিত করেছিলেন। এছাড়াও রায় পরিবারের সাথে জগদীশ চন্দ্র বসু, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের সম্পর্ক ছিল। উপেন্দ্রকিশোর ছাপার ব্লক তৈরির কৌশল নিয়ে গবেষণা করেন। এ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান। পরে ছাপার একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন।
সিটি কলেজ স্কুলে পড়াকালীন তাঁর সহপাঠীরা তাঁরই বিভিন্ন রচনায় থাকা বিখ্যাত চরিত্র 'পাগলা দাশু' চরিত্র নিয়ে নানা কাজ করেন। ১৯০৬ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে পদার্থবিজ্ঞান এবং রসায়ন বিভাগে ডিগ্রি পান। এখানেই তিনি ১৯০৭ সালে 'ননসেন্স ক্লাব' প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। যেখানে অভিনয়, রসিকতা বা হাস্যকর বিষয়গুলির জন্য লোকেরা যোগ দিতে পারে। ক্লাবের মুখপত্র পত্রিকা হিসাবে সাদে-বত্রিশ-ভাজা শুরু করেছিলেন। এর মাঝে কলেজে তিনি কমিক স্ক্রিপ্ট লিখতে থাকতেন এবং সেগুলিতে অভিনয়ও করতেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পঞ্চাশতম জন্মদিনে শান্তিনিকেতন গিয়ে তিনি এবং তাঁর ভাগ্নে অবনীন্দ্রনাথ 'গোড়ায় গলদ' নাটকে অভিনয় করেছিলেন।
বাবার মতো মুদ্রণ প্রযুক্তি এবং ফটোগ্রাফির প্রতি বেশ আগ্রহী ছিলেন সুকুমার রায়। ১৯১১ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে গুরুপ্রসন্ন ঘোষ বৃত্তি নিয়ে লন্ডন ফোটোগ্রাফি এবং লিথোগ্রাফিতে পড়াশোনা করতে যান। ১৯১৩ সালে সুকুমার কলকাতাতে ফিরে আসেন। সুকুমার ইংল্যান্ডে পড়াকালীন উপেন্দ্রকিশোর জমি কিনে উন্নত-মানের রঙিন হাফটোন ব্লক তৈরি করে একটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন। বিলেতে থাকাকালীন তিনি হাফটোন ব্লক নিয়ে লেখালেখি করতেন। দুটি লেখা বিলেতে প্রকাশিত হয়েছিল। বাডি ফিরে তিনি ছোটোদের মাসিক পত্রিকা 'সন্দেশ' প্রকাশনা শুরু করেন। সুকুমারের বিলেত থেকে ফেরার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই উপেন্দ্রকিশোরের মৃত্যু হয়। উপেন্দ্রকিশোর জীবিত থাকতে সুকুমার লেখার সংখ্যা কম থাকলেও উপেন্দ্রকিশোরের মৃত্যুর পর সন্দেশ পত্রিকা সম্পাদনার দায়িত্ব সুকুমার নিজের কাঁধে তুলে নেন। শুরু হয় বাংলা শিশু সাহিত্যের এক নতুন অধ্যায়। বাবার মৃত্যুর পর আট বছর ধরে তিনি সন্দেশ ও পারিবারিক ছাপাখানা চালিয়ে যান। ছোটোভাই কাজে তাঁকে সাহায্য করতেন।
অল্প বয়স থেকেই ফটোগ্রাফি পছন্দ করতেন সুকুমার রায়। ১৯০৪ সালে ১৭ বছর বয়সে তিনি ফোটোগ্রাফিতে পুরস্কার পান। ১৯১২ সালে ইংল্যান্ডে থাকাকালীন রয়েল ফটোগ্রাফিক সোসাইটিতে যোগদান করেছিলেন। এই সময়ে, তিনি স্লাইডিং ক্যালকুলেটর ডিজাইন করেছিলেন যা ফটো প্রসেসিংয়ের কাজের সময় ক্যামেরা সেট আপ করতে কাজে লেগেছিল। ১৯২২ সালে, মৃত্যুর কয়েক বছর আগে তিনি রয়েল ফটোগ্রাফিক সোসাইটির ফেলো নির্বাচিত হন। সেই সময় দ্বিতীয় ভারতীয় হিসেবে তিনি এই সম্নান পান।