কথিত আছে বঙ্গদেশে কালীপুজোর (Kali Puja) প্রবর্তন করেন কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ (Krishnananda Agamavagisha) (আনুমানিক ১৫০০-১৬০০ শতক) মতান্তরে ১৭৭৭ খ্রিষ্টাব্দে। তন্ত্রসাধক কৃষ্ণানন্দর হাত ধরে বাংলায় এসেছিলেন কালী। কৃষ্ণানন্দের আগে বাংলায় কালীপুজো হত ঘটে, যন্ত্রে কিংবা শিলাখণ্ডে। মূর্তিতে কালীপুজোর প্রচলন তখনও হয়নি। বাড়িতে নয়, পুজো হত শ্মশানে, নদীতীরে বা গভীর অরণ্যে। কৃষ্ণানন্দের প্রভাবে সেই শ্মশানবাসিনী কালী হয়ে উঠলেন বাঙালির শ্যামা। যে কালীপুজো এক সময়ে গৃহে ছিল নিষিদ্ধ, কৃষ্ণানন্দের হাত ধরেই সেই দেবী প্রবেশ করলেন বাংলার ঘরে ঘরে। ইতিহাস অনুযায়ী আঠারো শতকের শেষদিকে প্রথমবার বিশাল আকারে কালীপুজো হয় নদিয়ার কৃষ্ণনগরে। নবদ্বীপের রাজা কৃষ্ণচন্দ্র উৎসবটি ব্যাপকভাবে উদযাপন করতেন। আজ, এই কালীপুজোই বাংলার সবচেয়ে ব্যাপকভাবে পালিত উৎসবগুলির মধ্যে অন্যতম। মূল কালীপুজোর অনুষ্ঠান রাতেই হয়। নির্জলা উপোস রাখেন অনেকেই। মা কালীর প্রিয় ফুল হিসাবে ভক্তরা লাল জবা ব্যবহার করেন পুজোয়। এ ছাড়াও কলকাতায় রয়েছে বেশ কিছু কালী মন্দির। যেখানে নিত্য আরাধনার পাশাপাশি এই বিশেষ দিনেও ধূমধাম করে পুজো হয়। জেনে নেব রাজ্যের বেশ কয়েকটি বিখ্যাত কালী মন্দির।
দক্ষিণেশ্বের কালী মন্দির: ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয় এই মন্দির। মা ভবতারিণীর মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন রানি রাসমনি। মন্দিরের খ্যাতিলাভের পিছনে মুখ্য ভূমিকা ছিল শ্রী রামকৃষ্ণের। সেই আমল থেকে আজও একই ভাবে পুজো হয় দক্ষিণেশ্বরে। কথিত আছে, রানি রাসমনিদেবী স্বপ্নাদেশ পেয়ে এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। মন্দির প্রতিষ্ঠাকালে রামকৃষ্ণ পরমহংস-র দাদা রামকুমার চট্টোপাধ্যায় রানিকে প্রভূত সাহায্য করেছিলেন। রামকুমারই ছিলেন মন্দিরের প্রথম প্রধান পুরোহিত। ১৮৫৭-৫৮ সালে কিশোর রামকৃষ্ণ পরমহংস এই মন্দিরের পুজোর ভার গ্রহণ করেন। পরবর্তীকালে তিনি এই মন্দিরকেই সাধনক্ষেত্র রূপে বেছে নেন। আরও পড়ুন: Kali Puja 2019: বিলিতি খড়্গ দিয়ে বলি হয় কলকাতার এই বনেদী বাড়িতে; বউবাজারের হালদার বাড়িতে তিনশো বছর ধরে পূজিতা হন মা কালী
ঠনঠনিয়া কালীবাড়ি: এই মন্দির স্থাপিত হয় ১৮০৩ খ্রিস্টাব্দে। ভিন্ন মতে ১৩০৩ খ্রিস্টাব্দে। ১৭০৩ খ্রিষ্টাব্দে উদয়নারায়ণ ব্রহ্মচারী নামে জনৈক তান্ত্রিক মাটি দিয়ে সিদ্ধেশ্বরী কালীমূর্তি গড়েন। ১৮০৬ খ্রিষ্টাব্দে শংকর ঘোষ বর্তমান কালীমন্দির ও পুষ্পেশ্বর শিবের আটচালা মন্দির নির্মাণ করেন ও নিত্যপুজোর ব্যয়ভার গ্রহণ করেন। এখানে মায়ের মূর্তি মাটির, প্রতি বছর মূর্তি সংস্কার করা হয়। ঠনঠনিয়া কালীবাড়িতে জ্যৈষ্ঠ মাসে ফলহারিণীর পুজো, কার্তিক অমবস্যায় আদিকালীর পুজো ও মাঘ মাসে রটন্তী কালীর পুজো হয়।
ফিরিঙ্গি কালীবাড়ি: ৫০০ বছরের পুরনো মন্দির ফিরিঙ্গি কালীবাড়ি। মা সিদ্ধেশ্বরীর বিগ্রহে পুজো হয় এখানে। ফিরিঙ্গি কালীবাড়ি হল কলকাতার বউবাজার অঞ্চলে অবস্থিত একটি প্রাচীন কালী মন্দির। এটি স্থানীয় বিপিন বিহারী গাঙ্গুলি স্ট্রিটে অবস্থিত। স্থানীয় জনশ্রুতি অনুযায়ী, মন্দিরটি ৫০০ বছরের পুরোনো। অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি এই মন্দিরে আসতেন বলে এই মন্দিরটি ফিরিঙ্গি কালীবাড়ি নামে পরিচিত হয়। ফিরিঙ্গি কালীবাড়ি একটি চাঁদনি স্থাপত্যের মন্দির। এই মন্দিরের কালীমূর্তিটি মাটির তৈরি। এটি প্রায় সাড়ে পাঁচ ফুট লম্বা সবসনা ত্রিনয়না মূর্তি। কালীমূর্তি ছাড়াও মন্দিরে আছে শীতলা, মনসা, দুর্গা, শিব ও নারায়ণের মূর্তি। মন্দিরে প্রতি অমাবস্যায় কালীপুজো ও প্রতি পূর্ণিমায় সত্যনারায়ণ পুজো হয়।
কালীঘাট মন্দির: কালীঘাট মন্দির কলকাতার একটি প্রসিদ্ধ কালীমন্দির এবং একান্ন শক্তিপীঠের অন্যতম হিন্দু তীর্থক্ষেত্র। এই তীর্থের পীঠদেবী দক্ষিণাকালী এবং ভৈরব বা পীঠরক্ষক দেবতা নকুলেশ্বর। পৌরাণিক কিংবদন্তি অনুসারে, সতীর দেহত্যাগের পর তাঁর ডান পায়ের চারটি (মতান্তরে একটি) আঙুল এই তীর্থে পতিত হয়েছিল। ১৮০৯ সালে বড়িশার সাবর্ণ জমিদার শিবদাস চৌধুরি, তাঁর পুত্র রামলাল ও ভ্রাতুষ্পুত্র লক্ষ্মীকান্তের উদ্যোগে আদিগঙ্গার তীরে বর্তমান মন্দিরটি নির্মিত হয়েছে। পরবর্তীকালে মন্দিরের কিছু পোড়ামাটির কাজ নষ্ট হয়ে গেলে সন্তোষ রায়চৌধুরি সেগুলি সংস্কার করেন। বর্তমান এই মন্দিরটি ৯০ ফুট উঁচু। কালীঘাট কালীমন্দিরের কষ্টিপাথরের কালীমূর্তিটি অভিনব রীতিতে নির্মিত। মূর্তিটির জিভ, দাঁত ও মুকুট সোনার। হাত ও মুণ্ডমালাটিও সোনার। মন্দিরে মধ্যে একটি সিন্দুকে সতীর প্রস্তরীভূত অঙ্গটি রক্ষিত আছে, এটি প্রকাশ্যে আনা হয় না।
আদ্যাপীঠ: কলকাতার উত্তর প্রান্তে শক্তি আরাধনার অন্যতম পীঠস্থান। হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার ইচ্ছা ছিল অন্নদা ঠাকুরের। কিন্তু স্বপ্নে রামকৃষ্ণদেব বলেন, ইডেন জলাশয় থেকে মাতৃমূর্তি তুলে এনে মন্দির প্রতিষ্ঠা করতে। প্রতিষ্ঠা হয় আদ্যাপীঠ। শুধু মন্দির নয়। একই প্রাঙ্গনে রয়েছে মহিলা ও শিশুদের আশ্রম। তবে মূল মন্দিরে সাধারণের প্রবেশ নিষেধ। নিয়ম অনুযায়ী দীপান্বিতা অমাবস্যা শুরু হলেই তবেই পুজো হয়।
ময়দা কালীমন্দির : পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা জেলার ময়দা গ্রামে অবস্থিত একটি বিখ্যাত কালী মন্দির। ১১৭৬ বঙ্গাব্দে বড়িশার সাবর্ণ চৌধুরী আটচালা ময়দা কালীমন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। মন্দিরে গর্ভগৃহে অবস্থিত একটি শিলা কালী রূপে পুজিত হন। প্রায় ৭৩ শতক জায়গা জুড়ে মন্দিরপ্রাঙ্গণ। দক্ষিণমুখী প্রবেশপথ দিয়ে ঢুকেই চোখে পড়ল যূপকাষ্ঠ। সামনে নাটমন্দির, তার পিছনেই মূল মন্দির। মন্দিরে কোনও মূর্তি নেই। একটি চতুষ্কোণ গহ্বরে দেবীর প্রতীকস্বরূপ সিঁদুর মাখানো শিলাকে দক্ষিণাকালী ধ্যানে পুজো করা হয়।
সিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দির: অম্বিকা কালনার সিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দিরের প্রতিষ্ঠাকাল সম্বন্ধে জানা যায় না। ১৭৩৯ খ্রিষ্টাব্দে বর্ধমানের রাজা চিত্রসেন রায় এই প্রাচীন মন্দিরের সংস্কার করেন। জোড়বাংলা ধাঁচে তৈরি মন্দিরটি উঁচু ভিতের ওপর প্রতিষ্ঠিত। মন্দিরের বাইরের অংশে পোড়ামাটির কাজ রয়েছে। মন্দিরপ্রাঙ্গণে অষ্টাদশ শতাব্দীতে নির্মিত পাঁচটি শিবমন্দির বর্তমান। বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন যোগী অন্মুঋষি। গর্ভগৃহে নিমকাঠ নির্মিত চতুর্ভূজা মূর্তিটি প্রায় পাঁচ ফুট উচ্চতার। দেবী বিগ্রহের পদতলে শায়িত শিব। বামহস্তে খড়্গ ও নরমুণ্ড।
মহানাদের ব্রহ্মময়ী দক্ষিনা কালী মন্দির: হুগলি জেলার মহানাদের ব্রহ্মময়ী দক্ষিনা কালী মন্দির প্রায় একশো নব্বই বছরের প্রাচীন। কথিত আছে রানি রাসমণি এই মন্দিরে এসে এই মন্দির দেখেই দক্ষিণেশ্বরের মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। এই কালী মন্দিরকে নিয়ে আছে ইতিহাস। তৎকালীন জমিদার কৃষ্ণচন্দ্র নিয়োগী জমিদারির সাথে সাথে জলপথে ব্যবসা করতেন। বাড়িতে দুর্গা ও জগদ্ধাএী পুজো হলেও তিনি প্রতিদিন প্রতিমা দর্শন করে ব্যবসার কাজে বের হতে মনস্থির করেন। সেই মতো তান্ত্রিকদের সাথে কথা বলে ১৮৩০ সালে মহানাদে ব্রহ্মময়ী দক্ষিণা কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। পঞ্চমুন্ড আসনের উপর দাঁড়িয়ে আছেন ভবতারিনী কালী। মূর্তির নিচে নেই শিব মূর্তি। মন্দিরের চার কোণে আছে শিবলিঙ্গ। প্রতিদিন দিনের বেলায় পুজো হয়। সন্ধ্যায় সন্ধ্যারতি। শনি ও মঙ্গলবার বিশেষ ভোগ দেওয়া হয়।