কথিত আছে বঙ্গদেশে কালীপুজোর (Kali Puja) সূচনা করেছিলেন কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ (Krishnananda Agamavagisha)। আনুমানিক ১৫০০-১৬০০ শতক মতান্তরে ১৭৭৭ খ্রিষ্টাব্দে মা কালীর আরাধনা শুরু করেছিলেন তিনি। তাঁর হাত ধরেই বাংলায় পূজা পেয়েছিলেন মা কালী (Ma Kali)। মূর্তিতে কালীপুজোর প্রচলন তখনও হয়নি। কৃষ্ণানন্দের দেখান পথের আগে বাংলায় কালীপুজো হত ঘটে, যন্ত্রে কিংবা শিলাখণ্ডে। বাড়িতে নয় সেইসব দিনে পুজো হত শ্মশানে, নদীর তীরে কিংবা গভীর অরণ্যে। কৃষ্ণানন্দের আরাধনায় শ্মশানবাসিনী কালী হয়ে উঠলেন ঘরের মেয়ে। যে কালীপুজো এক সময়ে বাড়িতে ছিল নিষিদ্ধ, কৃষ্ণানন্দের হাত ধরে সেই দেবী প্রবেশ করলেন গৃহস্থের ঠাকুর ঘরে। এছাড়া আঠারো শতকের শেষের দিকে কালীপুজো হয়েছিল নদিয়ার কৃষ্ণনগরে। নবদ্বীপের রাজা কৃষ্ণচন্দ্র উৎসবটি ব্যাপকভাবে উদযাপন করতেন। মা কালীর দেখা পেতে সাধনা করে কত সাধারণ হয়ে উঠেছেন মায়ের সন্তান কালী সাধক।
আজ কালীপুজোর দিনে চলুন তাঁদের জানা যাক -
আরও পড়ুন: Kali Puja 2019: এই বিখ্যাত কালী মন্দিরগুলি সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানতেন?
রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব (Ramkrishna Paramhangsha Dev): ১৮৫৫ সালে রাণী রাসমণি দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ি প্রতিষ্ঠা করলে রামকুমার চ্যাটার্জি (রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের বাবা) সেই মন্দিরে প্রধান পুরোহিতের পদে নিযুক্ত হন। পরে ১৮৫৬ সালে রামকুমারের মৃত্যু হলে গদাধর তার স্থলাভিষিক্ত হন। রামকুমারের মৃত্যুর পর রামকৃষ্ণের ভাবতন্ময়তা বৃদ্ধি পায়। কালীকে তিনি মা ও বিশ্বজননীভাবে প্রত্যক্ষ করতে শুরু করেন। এই সময় দেবীর প্রত্যক্ষ রূপ দর্শনের জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠেন তিনি। তার বিশ্বাস পাষাণপ্রতিমা জীবন্ত হয়ে অন্নগ্রহণ করতে শুরু করে। পুজো করতে করতে দেবীর দর্শন না পেয়ে তিনি চিৎকার করে কেঁদে উঠতে থাকেন। রাতে নিকটবর্তী জঙ্গলে গিয়ে জামাকাপড় এবং পৈতে ত্যাগ করে নির্জনে ধ্যান করতেও শুরু করেন। একদিন অস্থিরতার বশে তিনি সংকল্প করেন দেবীর দর্শন না পেলে জীবন বিসর্জন দেবেন। দেওয়াল থেকে খড়্গ তুলে নিয়ে তিনি গলায় কোপ বসাতে যাবেন, এমন সময় হঠাৎ পুরো ঘর আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। এরপর শ্রীরামকৃষ্ণ তার প্রথম কালীদর্শনের যে বর্ণনা দেন, তা হল- "সহসা মার অদ্ভুত দর্শন পাইলাম ও সংজ্ঞাশূন্য হইয়া পড়িয়া গেলাম! তাহার পর বাহিরে কি যে হইয়াছে, কোন্ দিক দিয়া সেদিন ও তৎপরদিন যে গিয়াছে, তাহার কিছুই জানিতে পারি নাই! অন্তরে কিন্তু একটা অননুভূত জমাট বাঁধা আনন্দের স্রোত প্রবাহিত ছিল এবং মার সাক্ষাৎ প্রকাশ উপলব্ধি করিয়াছিলাম! ঘর, দ্বার, মন্দির সব যেন কোথায় লুপ্ত হইল। কোথাও যেন আর কিছুই নাই। আর দেখিতেছি কি, এক অসীম অনন্ত চেতন জ্যোতিঃ-সমুদ্র। যেদিকে যতদূর দেখি, চারিদিক হইতে তার উজ্জ্বল ঊর্মিমালা তর্জন-গর্জন করিয়া গ্রাস করিবার জন্য মহাবেগে অগ্রসর হইতেছে! দেখিতে দেখিতে উহারা আমার উপর নিপতিত হইল এবং আমাকে এককালে কোথায় তলাইয়া দিল! হাঁপাইয়া হাবুডুবু খাইয়া সংজ্ঞাশূন্য হইয়া পড়িয়া গেলাম।"
রামপ্রসাদ সেন (Ramprasad Sen): কলকাতার উত্তরে হুগলি নদীর তীরে হালিশহরে তান্ত্রিক বৈদ্য পরিবারে রামপ্রসাদ সেনের জন্ম। বাবা রামরাম সেন চেয়েছিলেন ছেলে রাম্প্রসাদ পারিবারিক চিকিৎসক বৃত্তি গ্রহণ করুক। কিন্তু রামপ্রসাদের সেদিকে আগ্রহ ছিল না। তিনি আধ্যাত্মিক জীবনযাপনেই সুখী ছিলেন। কথিত আছে, দীক্ষাগ্রহণকালে গুরু তার কানে মন্ত্রপ্রদান করলে তিনি দেবী কালীর অনুরক্ত হয়ে পড়েন। এক বছর পর তার গুরুর মৃত্যু হয়। এরপর রামপ্রসাদ তান্ত্রিক যোগী ও পণ্ডিত কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। রামরাম সেনের মৃত্যু হলে দারিদ্র্যের বশবর্তী হয়ে রামপ্রসাদকে কলকাতায় এসে দুর্গাচরণ মিত্র নামে এক ধনীর কাছারিতে মাসিক ত্রিশ টাকা বেতনে কেরানির কাজ শুরু করতে হয়। জনশ্রুতি আছে, কাছারির হিসাবের খাতায় শ্যামাসঙ্গীত লিখতেন তিনি। যা জানতে পেরে অন্যান্য কর্মচারীরা রামপ্রসাদের বিরুদ্ধে নালিশ জানান। কিন্তু দুর্গাচরণ গানগুলি পড়ে রামপ্রসাদের কবিত্বে মুগ্ধ হয়ে যান। তিনি কবিকে কেরানির কাজ থেকে অব্যহতি দিয়ে স্বগ্রামে প্রেরণ করেন। তার মাসিক ভাতারও ব্যবস্থা করে দেন। গ্রামে ফিরে রামপ্রসাদ কঠোর সাধনায় মগ্ন হন। তন্ত্রসাধনার আদর্শ পবিত্র এক পঞ্চবটীর তলায় পঞ্চমুণ্ডীর আসনে তিনি ধ্যান ও সাধনা করতেন। লোকবিশ্বাস অনুযায়ী, দেবী কালী আদ্যাশক্তি মহামায়া রূপে এই সময় তাকে দর্শন দিয়েছিলেন।
বামাক্ষ্যাপা (Bamakhyapa): ছেলেবেলায় গৃহত্যাগ করে তিনি কৈলাশপতি বাবা নামে এক সন্ন্যাসীর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। কৈলাশপতি বাবা তারাপীঠে থাকতেন। পরে তিনি নিকটবর্তী মল্লরাজাদের মন্দিরময় গ্রাম মালুটিতে যান যোগ সাধনার জন্যে। সেখানে দ্বারকার তীরে মৌলাক্ষী দেবীর মন্দিরে সাধনাকালে প্রায় ১৮ মাস অবস্থান করেন। ক্রমে তিনি তারাপীঠের প্রধান ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠেন। ভক্তরা রোগারোগ্য ও অন্যান্য প্রয়োজনে তার কাছে আসত। কথিত আছে, নাটোরের মহারাণী স্বপ্নে দেবী তারার প্রত্যাদেশ পান, দেবীপুত্র বলে বামাকে যেন আগে খাওয়ানো হয়। এরপর থেকে মন্দিরে পুজোর আগেই বামাকে নৈবেদ্য প্রদান করা হত। আরও কথিত আছে, মা তারা ভয়ংকর বেশে বামাকে দর্শন দিয়েছিলেন। পরে মাতৃবেশে কোলে তুলে নিয়েছিলেন। তারাপীঠ শ্মশানে ও দুমকা জেলার মালুটি গ্রামে তার স্মৃতিমন্দির আছে।
কমলাকান্ত ভট্টাচার্য (Kamalakanta Bhatterjee): কমলাকান্ত ভট্টাচার্য ১৭৭২ খ্রিষ্টাব্দে বর্ধমানের চান্না গ্রামে নিজের মাতুলালয়ের জন্মগ্রহণ করেন। বর্ধমানের মহারাজ তেজচন্দ্র তার উচ্ছৃঙ্খল পুত্র প্রতাপচন্দ্রকে শিক্ষা দীক্ষায় উপযুক্ত করে তোলার জন্য কমলাকান্তকে বর্ধমানে নিয়োগ দেন। লাকুড্ডিতে তার বাড়ি তৈরি করে দেন। কোটালহাটে কমলাকান্তের সাধন ভজনের জন্য মন্দিরও করে দেন। সেখানে কমলাকান্ত কালীমূর্তি প্রতিষ্ঠা করে পঞ্চমুন্ডীর আসনে বসে সাধনা করতেন। কমলাকান্ত প্রায় শতাধিক ভক্তিগীতি রচনা করেন।