শিবপুরাণ অনুসারে, শিব চিরন্তন, আদি, অন্ত, অসীম। শিবই শুরু, শিবই শেষ। সনাতন ধর্মের চূড়ান্ত কারণ ও কর্ম শিব। শিবই ধর্মের মূলে শিব। শিব ধর্ম, অর্থ, কাম এবং মোক্ষ। সমগ্র সৃষ্টি সুরক্ষার মূলে শিব। অর্থাৎ কোনও ব্যক্তি জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে শিবকে অপমান করলে মহাবিশ্ব কখনও ক্ষমা করে না তাকে। মহাশিবরাত্রি উপলক্ষে জেনে নেওয়া যাক মহাবিশ্ব সৃষ্টির আগে কিভাবে ভগবান শিব সৃষ্টি করেছিলেন ভগবান বিষ্ণু ও ব্রহ্মাকে।
শিবপুরাণ অনুসারে, যখন সর্বত্র অন্ধকার ছিল, যখন সূর্য চন্দ্র গ্রহ নক্ষত্রের অস্তিত্ব ছিল না, এমনকি যখন আগুন, মাটি, জল, বায়ু ছিল না, সেই সময় একমাত্র শক্তির অস্তিত্ব ছিল, শিব, যাকে বলা হয় অনাদি এবং চিন্ময়। ভগবান সদাশিবকে বেদ, পুরাণ ও উপনিষদের পাশাপাশি বলা হয় সাধক মহাত্মা আদি ঈশ্বর এবং সর্বলোক মহেশ্বরম।
শিব যখন মহাবিশ্ব সৃষ্টির প্রয়োজন অনুভব করেন তখন সর্বপ্রথম পরাশক্তি অম্বিকাকে বলেন বিশ্বজগতের সৃষ্টির জন্য এমন একজন মহাপুরুষ প্রয়োজন যার হাতে মহাবিশ্ব পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করা সম্ভব। এরপর শিব তাঁর বাম অঙ্গের দশম অংশে অমৃত প্রয়োগ করে জন্ম দিয়ে ছিলেন এক দিব্য পুরুষের। তাঁর সৌন্দর্য ছিল অতুলনীয়। তিনি ছিলেন অতল সমুদ্রের মতো শান্ত ও গম্ভীর। তাঁর শরীর ছিল রেশমি হলুদ রঙের, যা তাঁর সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে তুলেছিল। তাঁর হাতে ছিল শঙ্খ, চক্র, গদা ও পদ্ম।
দিব্যপুরুষ শিবকে প্রণাম করে নিজের নাম ও কর্ম নির্ধারণ করার অনুরোধ করেন। শিব দিব্যপুরুষের নাম বিষ্ণু দেওয়ার পর তাঁকে বলেন সৃষ্টির আনুগত্য করা হবে তাঁর সর্বোচ্চ কর্তব্য। এরপর তাঁকে তপস্যা শুরু করার কথা বলেন। ভগবান শিবের আদেশ পেয়ে দিব্যপুরুষ বিষ্ণু কঠোর তপস্যায় লিপ্ত হন। এরপর তাঁর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ থেকে প্রবাহিত হয় জলের ধারা, সেই জলে ভরে যায় শূন্য আকাশ। অবশেষে তিনি ক্লান্ত হয়ে সেই জলে শুয়ে পড়েন। জলে শুয়ে থাকার কারণে তার নাম হয় নারায়ণ। ঘুমন্ত নারায়ণের নাভি থেকে ফুটে ওঠে একটি পদ্ম। শিব তার ডান অঙ্গ থেকে চতুর্মুখী ব্রহ্মাকে প্রকাশ করে পদ্মের উপর বসিয়ে দিলেন।
মহেশ্বরের মায়ায় মুগ্ধ হয়ে ব্রহ্মাজী দীর্ঘকাল পদ্মের কাণ্ডে ঘুরে বেড়ালেও নিজের প্রবর্তককে খুঁজে পাননি। আকাশবাণীর মাধ্যমে দীর্ঘ তপস্যার আদেশ পেয়ে ব্রহ্মাজী তাঁর সৃষ্টিকর্তার দর্শন পাওয়ার জন্য বছরের পর বছর কঠোর তপস্যা করেন। এরপর ভগবান বিষ্ণু সামনে এলে বিষ্ণুজী ও ব্রহ্মাজীর মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে জন্ম হয় বিবাদের। আচমকা তাঁদের মধ্যে তৈরি হয় একটি ঐশ্বরিক স্তম্ভ। অনেক চেষ্টার পরও ব্রহ্মা বিষ্ণু সেই স্তম্ভের আদি অন্ত খুঁজে না পেয়ে অবশেষে ক্লান্ত হয়ে মহাপ্রভুকে দর্শন দেওয়ার জন্য প্রার্থনা করেন। ব্রহ্মা বিষ্ণুর তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে মহেশ আবির্ভূত হয়ে ব্রহ্মাজীকে জগৎ সৃষ্টির এবং বিষ্ণুজীকে জগতের যত্ন নেওয়ার দায়িত্ব দেন। এরপর ভগবান শিব তাঁর হৃদয় থেকে রুদ্রর জন্ম দিয়ে তাঁকে ধ্বংসের দায়িত্ব দেন।