ভোট গণনার দশ ঘণ্টা অতিক্রান্ত। এবার মোটের ওপর দেশের ভোটচিত্র পরিষ্কার। এনডিএ ২৯৪, ইন্ডিয়া ২৩৪টি আসনে হয় এগিয়ে বা জিতে গিয়েছে। দুই জোটের মধ্যে ব্যবধান মাত্র ৬০টি-র। মানে ৩০টি আসনে ফল এদিক ওদিক হলেই অন্যরকম হয়ে যেত। কর্ণাটক, তেলাঙ্গানায় কংগ্রেস প্রত্যাশিত ফল করলে এই ব্যবধান মুছে যেত।
কোন দল কটি আসনে এগিয়ে/জিতল
বিজেপি: ২৩৪ (এর মধ্যে জয়ী হয়েছেন ১১১ জন)
কংগ্রেস: ৯৯ (এর মধ্যে জয়ী ৩৯)
সপা: ৩৪ (এর মধ্যে জয়ী ৪)
তৃণমূল: ২৯ (এর মধ্যে জয়ী ৭)
১) নরেন্দ্র মোদী কি প্রধানমন্ত্রী থাকবেন?
বিজেপি এককভাবে না পারলেও, নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে এনডিএ দেশের ক্ষমতায় থাকার ম্যাজিক ফিগার ছাড়িয়ে গিয়েছে। ম্যাজিক সংখ্যা যেখানে ২৭২, সেখানে এনডিএ ২৯৩টি-তে এগিয়ে। সেখানে ইন্ডিয়া জোট এগিয়ে ২৩১টি আসনে। নির্দল ও অন্য দলগুলিকে পেয়েছে ১৯টি আসন। তাই মোদী টানা তিনবার ক্ষমতায় বসছেন। কিন্তু সমস্যা হল এনডিএ শিবিরের দুই বড় দল নীতীশ কুমারের জেডি (ইউ) ও চন্দ্রবাবু নাইডুর টিডিপি ঘুরে গেলেই আসন টলমল হয়ে যেতা পারে। নীতীশ-চন্দ্রবাবু দুজনের সঙ্গেই আবার মমতার সম্পর্ক দারুণ।
২) মোদীকে সরকার বাঁচাতে হলে কোন কোন দলকে বেশী গুরুত্ব দিতে হবে
অবশ্যই চন্দ্রবাবু নাইডুর টিডিপি, নীতীশ কুমারের জনতা দল ইউনাইটেড। সঙ্গে চিরাগ পাসোয়ানকেও চটালে চলবে না। মহারাষ্ট্রে একনাথ শিন্ডেকেও ক্ষমতায় রাখতে হবে।
৩) কংগ্রেস ১০০-র কাছাকাছি আসনটা জেতাটা নিয়ে এত গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে কেন?
বহু বছর বাদে কংগ্রেস লোকসভা নির্বাচনে সম্মানীয় ফল করল। কর্ণাটক, বিহার, বাংলায় আর একটু আসন বাড়াতে পারলে কংগ্রেস আরও অপ্রত্যাশিত ফল করতে পারত। লোকসভা নির্বাচনের মুখে রাজস্থান,ছত্তিশগড়ে ক্ষমতা হারিয়ে আর মধ্যপ্রদেশে খড়কুটোর মত উড়ে গিয়ে একেবারে চাপে ছিল কংগ্রেস। মহারাষ্ট্রের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অশোক চৌহান থেকে শুরু করে দিল্লি কংগ্রেসের প্রধান অমরিন্দর সিং লাভলি- একে একে বড় নেতারা হাত ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দিতে শুরু করেন। তার ওপর আবার দলের ব্যাঙ্ক অ্যাকউন্টও ভোটের ঠিক আগে আটকে গিয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী মোদী তো বলেছিলেন, কংগ্রেস এবার কুড়ির নিচেও নেমে যেতে পারে। কিন্তু রাহুল গান্ধীর ভারত জোড়ো যাত্রা, নজরকাড়া ইস্তেহার, প্রচারে সুকৌশলভাবে সামাজিক সমস্যাগুলিকে তুলে ধরে সুফল পেল কংগ্রেস।
৪) মোদীকে গদিতে রাখতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা কোন কোন রাজ্য নিল
গুজরাট, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, দিল্লি, হিমাচল প্রদেশের মত রাজ্যে গতবারের মতই ভাল করেছে বিজেপি। কিন্তু উত্তর প্রদেশ, হরিয়ানা,
৫) কংগ্রেসের এই অপ্রত্যাশিত ভাল ফলের কারণ কী
রাহুল গান্ধীর ভারত জোড়ো যাত্রা, নজরকাড়া ইস্তেহার, প্রচারে সুকৌশলভাবে সামাজিক সমস্যাগুলিকে তুলে ধরে সুফল পেল কংগ্রেস।
৬) বিজেপি-র ৪০০ পাড় স্লোগান মুখথুবড়ে পড়ল কেন
আসলে বিজেপি কখনই চারশো পাওয়ার মত জায়গায় ছিল না। মিডিয়া প্রচারে সেটা বেশী প্রচার করতে গিয়ে ভোটারদের একাংশ ক্ষুব্ধ হয়। নরেন্দ্র মোদীর প্রচারেও এবার অপ্রাসঙ্গিক কিছু বিষয় ছিল বলেও ভোটারদের একাংশ মনে করেছেন। ইডি, সিবিআইয়ের অপব্যবহারের অভিযোগটা বিরোধীরা ভোটারদের মধ্যে পৌঁছে দিতে পেরেছিলেন। তা না হলে, মোদী ফ্যাক্টার, বিজেপির এত সুশৃঙ্খলা সংগঠন, অর্থবল থাকা সত্ত্বেও আড়াইশোর নিচে যাওয়ার কথা নয়।
৭) তৃণমূল বড় জয় পেল, বাংলার রাজনীতিতে এবার কী প্রভাব পড়বে?
বাংলায় বিজেপির পক্ষে কাজটা আরও অনেক কঠিন হল। দক্ষিণবঙ্গে এবার দল ধরে রাখা সহজ হবে না বিজেপির। তমলুক, কাঁথি ধরে রাখলেও মেদিনীপুরের বাকি অংশ, দক্ষিণবঙ্গের বেশ কিছু আসনে শুভেন্দু অধিকারী-র নেতৃত্ব এবার দলের অন্দরেই প্রশ্ন উঠবে। দিলীপ ঘোষের হারটা বিজেপির কাজটা কঠিন করবে। অনেক খারাপের মাঝেও বিজেপির পক্ষে ভাল খবর বনগাঁর জয়। কিন্তু শান্তনু ঠাকুর যে মার্জিনে জিতলেন মতুয়া গড়ে, তাতে দু বছর বাদে বিধানসভা ভোটে সেখানে তৃণমূলকে রোখা কঠিন হবে। সব মিলিয়ে এই লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূলের ২৯-৩০টি আসনে জয়, ২০২৬ বিধানসভা ভোটে মমতার ক্ষমতায় থাকার কাজটা অনেকটাই সহজ করে দিল। আর শুভেন্দু অধিকারী-র রাজনৈতিক কেরিয়ার নিয়ে নতুন প্রশ্নচিহ্ন তৈরি হল।
৬) বাংলায় এক্সিট পোল এভাবে মুখথুবড়ে পড়ল কেন?
সমীক্ষকরা সম্ভবত বাংলার লোক ছিলেন না। মাঠে সারা বছর থাকা রিপোর্টারদের ফিডব্য়াকও তারা নেননি। এই নিয়ে কিছু চ্যানেলের সাংবাদিকদেরও ঘনিষ্ঠমহলে অভিযোগ করেছেন। তা না হলে কলকাতা দক্ষিণ, বসিরহাটের মত কেন্দ্রেও এক্সিট পোলে বলা হয়েছিল বিজেপি জিতছে। একধাপ এগিয়ে এক বেসরকারী টিভি চ্যানেলের প্রাক নির্বাচনী সমীক্ষায় দেখানো হয়েছিল, ডায়মন্ড হারবারে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এগিয়ে থাকলেও চাপে আছেন। এক্সিট পোলের কাজে এবার থেকে রাজ্যের রাজনীতি জানা মানুষদের পাঠাক সংস্থাগুলি।
৭) অনেকে সেলিব্রিটি এবার ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন, তাদের কী হল
বেশীরভাগ সেলিব্রিটিই জিতেছেন। মান্ডিতে বলিউড অভিনেত্রী কঙ্গনা রানওয়াত জিতে প্রথমবার সাংসদ হলেন। তৃণমূলের দিদি নম্বর ওয়ান প্রার্থী রচনা বন্দ্যোপাধ্যায় জিতলেন হুগলি থেকে। হেমা মালিনী পরপর তিনবার জিতলেন মথুরা থেকে। গোরক্ষপুরে ফের জিতলেন বিজেপির বলিউড-ভোজপুরী তারকা রবি কিষাণ। দিল্লিতে কানহাইয়া কুমারকে হারিয়ে সেই আসনে হ্যাটট্রিক করলেন ভোজপুরী গায়ক-নায়ক মনোজ তিওয়ারি। আসানসোল থেকে বিজেপি-র টিকিট প্রত্যাখান করে বিহারের কারাকাট লোকসভায় কাঁচি চিহ্ন নিয়ে নির্দল প্রার্থী হয়ে দাঁড়িয়ে হারলেন ভোজপুরী নায়ক-গায়ক পবন সিং।
তবে দিনের সবচেয়ে বড় ব্রেকিং আমেথি থেকে অভিনেত্রী-কেন্দ্রীয় মন্ত্রী স্মৃতি ইরানির হার। গান্ধীরা না দাঁড়ালেও হেরে গেলেন স্মৃতি। হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের পর ইউপি-র মিরাঠ কেন্দ্র থেকে এগিয়ে পর্দার রাম বিজেপি-র অরুণ গোভিল। বাংলায় তারকাদের মধ্যে রচনা ছাড়াও অনায়াসে জিতেছেন দেব। বীরভূমে এগিয়ে রয়েছেন শতাব্দী রায়। যাদবপুরে বড় ব্যাবধানে জিতে সাংসদ হলেন সায়নী ঘোষ। তবে বাংলায় বিজেপি-র সেলেব প্রার্থীরা সব হেরেছেন- রচানার কাছে হেরেছেন লকেট চট্টোপাধ্যায়, ঘাটালে দেবের কাছে হেরেছেন হিরণ। ব্যারাকপুরে পার্থ ভৌমিকের জয়ে তৃতীয় হয়েছেন সিপিএমের তারকা প্রার্থী দেবদূত ঘোষ।
৮) হেভিওয়েট আসনগুলোর ফল কোন দিকে গেল
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী শুরুতে পিছিয়ে থাকলেও বারাণসী থেকে দেড় লক্ষ ভোটের ব্যবধানে জিতেছেন। মোদীর জয়ের ব্যবধান অনেকটাই কমেছে। বিশেষ করে রামমন্দিরের মত ইস্যু নিয়ে ভোটযুদ্ধে নেমেও মোদীর মার্জিন দেখে হতাশ বিজেপি। রাহুল গান্ধী কেরলের ওয়ানাড় ও ইউপি-র -রায়বারেলি-দুটি আসনেই বড় ব্যবধানেই জিতেছেন। গতবার সোনিয়া যে ব্যবধানে জিতেছিলেন, তার চেয়েও বেশী ব্যবধানে জিতলেন রাহুল। যেখানে ক মাস আগে রামমন্দির উদ্বোধন করে দেশজুড়ে ঝড় তুলেছিলেন মোদী, সেই অযোধ্য়া-তেই হারের পথ বিজেপি। অযোধ্যা হল ফৈয়জবাদ লোকসভার অন্তর্গত। সেখানে ৪০ হাজার ভোটে এগিয়ে সপা-র প্রার্থী।
বিজেপির বেশীরভাগ কেন্দ্রীয় মন্ত্রীই জিতেছেন। তবে স্মৃতি ইরানি-র হারটা বিজেপির কাছে হতাশার।
৯) সবচেয়ে চমকপ্রদ ফল কোনগুলি
সবচেয়ে অবাক করা হল কাশ্মীরের দুই কেন্দ্রে- বারামুলা কেন্দ্রে হারলেন এনসি-র ওমর আবদুল্লা। সেখানে জিতলেন জেলবন্দি নির্দল প্রার্থী শেখ ইর রশিদ। অনন্তনাগে হারলেন পিডিপি প্রধান মেহবুবা মুফতি।
১০) এবারের ভোটে ম্যান অফ দি ম্যাচ কে বা কারা
এত বড় দেশ, এতগুলো আসন কোনও একজনকে বাছা কঠিন। তবে তালিকা করলে সবার আগের দিকে রাখতে হবে- মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (পশ্চিমবঙ্গ), রাহুল গান্ধী (কংগ্রেস), চন্দ্রবাবু নাইডু (অন্ধ্রপ্রদেশ), উদ্ভব ঠাকরে (মহারাষ্ট্র), অখিলেশ যাদব (উত্তর প্রদেশ), দিপেন্দর হুডা (হরিয়ানা)। তবে ম্যান অফ দি সিরিজ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। টানা তিনলার তিনি দেশের ক্ষমতায় আসছেন।