WB BJP President Sukanta Majumdar (Photo Credit: X)

পার্থ প্রতিম চন্দ্র: রাজ্যে লোকসভা নির্বাচনে প্রথম দফায় কিছু বিক্ষিপ্ত ঘটনা বাদ দিলে শান্তিপূর্ণভাবেই ভোটগ্রহণ হয়েছে। শুক্রবার জলপাইগুড়ি, কোচবিহার ও আলিরপুরদুয়ারে প্রায় ৮০ শতাংশ ভোট পড়ে। তৃণমূল ও বিজেপি দুই পক্ষেরই দাবি তাদের পক্ষেই জনতার রায় যাবে। এবার আগামী শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল দ্বিতীয় দফায় ভোট হতে চলেছে উত্তরবঙ্গের আরও তিন লোকসভা আসন- দার্জিলিং, রায়গঞ্জ ও বালুরঘাটে। পাহাড়ে গুরুংদের সমর্থনে বিজেপি-র গড় রক্ষার লড়াই। বালুরঘাটে বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারের কঠিন পরীক্ষা। আর রায়গঞ্জে প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সির জমিতে ত্রিমুখি লড়াইয়ে বিজেপি, তৃণমূলকে টক্কর দিচ্ছেন কংগ্রেসের দাপুটে নেতা আলি ইমরান রামজ (ভিক্টর)-ও।

প্রথম দফার মতই দ্বিতীয়তেও গত লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি সব কটা আসনে জিতেছিল। তবে দু বছর বাদে বিধানসভা নির্বাচনে এই তিন লোকসভায় তৃণমূল নিজেদের হারনো জমি উদ্ধার করতে পেরেছে। আরও পড়ুন-রাজ্যের যে ১৫টি আসনে লুকিয়ে রয়েছে বাংলা জয়ের ফর্মুলা, জানুন এগিয়ে কারা

দ্বিতীয় দফার ভোটে তৃণমূলের লক্ষ্য হবে অন্তত দুটি আসনে জয় পাওয়া। রাজ্যে বিজেপির দাপট কমাতে হলে উত্তরবঙ্গে ভাল ফল করতেই হবে তৃণমূলকে। আর প্রথম দফার চেয়ে তৃণমূলের মাটিতে দ্বিতীয় দফায় অপেক্ষাকৃত বেশী মজবুত বলেই মনে করা হচ্ছে। সেখানে বিজেপিকে তিনটি আসনেই জিততেই হবে। কারণ এরপর থেকেই রাজ্যে গেরুয়া শিবিরের কঠিন পরীক্ষা শুরু হচ্ছে। এ কথা সবার জানা পদ্ম শিবিরকে গত লোকসভার মত বা তার চেয়ে বেশী আসন পেতে হলে উত্তরবঙ্গে গেরুয়া গড় অটুট রাখতেই হবে। অন্যদিকে, প্রথম দফায় সেভাবে দেখা না গেলেও এবার কংগ্রেস ও বামেদের প্রভাব থাকছে। দার্জিলিংয়ে কংগ্রেসের মুনীশ তামাং ও রায়গঞ্জে ভিক্টর জয়-পরাজয়ে ব্যবধান গড়ে দিতে পারেন।

আসুন এক নজরে দেখে নেওয়া যাক দ্বিতীয় দফায় হতে চলা তিনটি লোকসভা আসনের কথা

১) দার্জিলিং লোকসভা আসন

২০০৯ লোকসভা থেকে টানা তিনবার পাহাড়ের এই আসনে জিতে আসছে বিজেপি। এই প্রথম দার্জিলিং লোকসভা আসনে প্রার্থী বদল করেনি বিজেপি। ২০০৯ লোকসভায় এখানে জিতেছিলেন বিজেপি-র যশবন্ত সিং, পাঁচ বছর বাদে জেতেন সুরিন্দর সিং আলুওয়ালিয়া। ২০১৯ লোকসভায় প্রার্থী বদল করে রাজু বিস্তা-কে দাঁড় করায় বিজেপি। তিনবারই গোর্খা জনমুক্ত মোর্চার সমর্থনে বড় ব্যবধানে জেতে পদ্ম শিবির। এবারও প্রার্থী বদলের জল্পনা থাকলেও শেষ অবধি বিদায়ী সাংসদ রাজু বিস্তা-কেই টিকিট দেয় গেরুয়া শিবির। সেই ক্ষোভে নির্দল প্রার্থী হয়ে লড়ছেন কার্শিয়াংয়ের বিজেপি বিধায়ক বিষ্ণুপ্রসাদ শর্মা।

অন্যদিকে, বাইচুং ভুটিয়া, অমর সিং রায়-রা যা পারেননি সেটাই করে দেখাতে এবার দিদি পাহাড়ে প্রার্থী করেছেন প্রাক্তন আমলা গোপাল লামা-কে। ভূমিপুত্র কাজের মানুষ গোপাল লামা প্রচারে নেমে ভাল সাড়া পাচ্ছেন। তবে তাঁকে অন্তত চার লক্ষ মার্জিনের ব্যবধান মুছতে হবে। কংগ্রেসের প্রার্থী মুণিশ তামাংও প্রার্থী হিসেবে ভাল। তবে পাহাড়ে কংগ্রেসের সংগঠন একেবারেই ভাল নয়।

এবার লোকসভা নির্বাচনে উল্লেখযোগ্য প্রার্থীরা

রাজু বিস্তা (বিজেপি)

গোপাল লামা (তৃণমূল)

মুণিশ তামাং (কংগ্রেস)

বিষ্ণু প্রসাদ শর্মা (নির্দল)

গতবার এই কেন্দ্রে বিজেপি-র রাজু বিস্তা প্রায় ৪ লক্ষ ১৫ হাজার ভোটের ব্যবধানে জিতেছিলেন তৃণমূলের অমর সিং রাইয়ের বিরুদ্ধে। ৬৫ হাজার ভোট পেয়ে তৃতীয় হয়েছিলেন কংগ্রেসের শঙ্কর মালাকার, মাত্র ৫০ হাজার ভোট পেয়ে চতুর্থ হন সিপিএমের সমন পাঠক। এবার কংগ্রেস প্রার্থী মুণিশ তামাংকে সমর্থন করছে সিপিএম।

কারা এগিয়ে- দার্জিলিং, কার্শিয়াং, মাটিগাড়া-নকশালবাড়ি, শিলিগুড়ি, ফাঁসিদেওয়া, কালিম্পিং, ও চোপড়া এই সাতটি বিধানসভা আসন নিয়ে দার্জিলিং লোকসভা গঠিত। তার মধ্যে প্রথম পাঁচটি কেন্দ্র দার্জিলিং জেলা, ও বাকি দুটি যথাক্রমে কালিম্পিং ও উত্তর দিনাজপুর জেলায় অবস্থিত। ২০২১ বিধানসভায় দার্জিলিং জেলার সব কটি বিধানসভাতেই জিতেছিলেন বিজেপির প্রার্থীরা। কালিম্পিংয়ে জিতেছিলেন গোর্খা প্রজাতান্ত্রি মোর্চা ও চোপড়ায় তৃণমূলের প্রার্থী সহজ জয় পেয়েছিলেন। অঙ্কের বিচারে এবারও তাই দার্জিলংয়ে সহজ জয় পাওয়ার কথা বিজেপির। কিন্তু বাস্তব তেমনটা বলছে না। কার্শিয়াংয়ের বিজেপি বিধায়ক তথা স্থানীয় নেতা বিষ্ণুপ্রসাদ শর্মা-নির্দল হয়ে দাঁড়ানোয় চিন্তা বাড়ছে রাজু বিস্তা-র। এবার বিজেপির পিছনে বিমল গুরুংয়ের সমর্থন থাকলেও পাহাড়ের নয়া রাজনৈতিক সমীকরণে সেটা বিজেপিকে কতটা সাহায্য করবে সেটাই দেখার।

-----------------------

২) বালুরঘাট:

বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার বনাম রাজ্যের মন্ত্রী বিপ্লব মিত্র। একেবারে সমানে সমানে লড়াই। গতবার তৃণমূলের অর্পিতা ঘোষকে হারিয়ে প্রথমবার সাংসদ হয়েছিলেন অধ্যাপক সুকান্ত মজুমদার। এবার এই আসনে জোর টক্কর। কারণ হরিরামপুরের বিধায়ক বিপ্লব মিত্র এই কেন্দ্রকে হাতের তালুর মত চেনেন। ২০০৯ লোকসভায় আরএসপি গড় হিসেবে পরিচিকত বালুরঘাটে দলের তেমন কোনও সংগঠন ছাড়াই ৩ লক্ষ ৮৩ হাজার ভোট পেয়েছিলেন। শেষে অবশ্য মাত্র পাঁচ হাজার ভোটে আরএসপি-র প্রশান্ত মজুমদারের কাছে হেরে গিয়েছিলেন বিপ্লব। এরপর টানা দুটো লোকসভা ভোটে তাঁকে আর টিকিট দেয়নি দল। ক্ষোভে দল ছেড়েছিলেন। কিন্তু তৃণমূল অন্তপ্রাণ বিপ্লব, ফের দিদির কথা শুনে ফিরে এসে দলের হাল ধরেন। সুকান্ত মজুমদার এখানে দলের সংগঠন তৈরি করতে পেরেছেন।

২০২৪ লোকসভার প্রার্থীরা

সুকান্ত মজুমদার (বিজেপি)

বিপ্লব মিত্র (তৃণমূল)

জয়দেব সিদ্ধান্ত (আরএসপি)

মোজাম্মেল হক (আইএসএফ)

বীরেন মোহন্ত (এসইউসিআই)

গতবারের ফল- তৃণমূলের অর্পিতা ঘোষকে ৩৩ হাজার ভোটের ব্যবধানে হারান বিজেপি-র সুকান্ত মজুমদার। আরএসপি প্রার্থী পেয়েছিলেন ৭৩ হাজার ভোট।

কে এগিয়ে- এই লোকসভার চারটি বিধানসভায় তৃণমূলের বিধায়ক, তিনটিতে জিতেছিল বিজেপি। অঙ্কের বিচারে সামান্য এগিয়ে তৃণমূল। তবে প্রচারে এগিয়ে সুকান্ত মজুমদার।

---------------

৩) রায়গঞ্জ:

ত্রিমুখি লড়াই। গতবারের জয়ী দেবশ্রী চৌধুরীকে এবার আর রায়গঞ্জে টিকিট দেয়নি বিজেপি। তার বদলে কালিয়াগঞ্জের পুরপ্রধান কার্তিক পাল পদ্ম প্রার্থী হয়েছেন। প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সির গড় রায়গঞ্জ লোকসভা এখনও পর্যন্ত কখনও জেতেনি তৃণমূল। এবার তৃণমূল প্রার্থী করেছে বিজেপি থেকে আসা কৃষ্ণ কল্যাণী-কে। কংগ্রেস প্রার্থী আলি ইমরান রামজ (ভিক্টর) এখানে বড় ফ্যাক্টর। গত লোকসভা ভোটে এখানে বিজেপি-র দেবশ্রী চৌধুরী নিকটতম তৃণমূল প্রার্থী কানাইল লাল আগরওয়ালের বিরুদ্ধে জিতেছিলেন ৬০ হাজারের মত ভোটে, সেখানে সিপিএম প্রার্থী মহম্মদ সেলিম ১ লক্ষ ৮৩ হাজার ভোট পেয়েছিলেন। রায়গঞ্জ লোকসভার ৭টি-র মধ্যে ৬টি-তেই তৃণমূলের বিধায়ক। একমাত্র কালিয়াগঞ্জ বিধানসভা বিজেপির দখলে আছে। কংগ্রেস প্রার্থী ভিক্টরের ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে।

২০২৪ লোকসভার প্রার্থীরা

কার্তিক পাল (বিজেপি)

কৃষ্ণ কল্যাণী (তৃণমূল)

আলি ইমরান রামজ (কংগ্রেস)

গতবারের ফল-বিজেপি-র দেবশ্রী চৌধুরী প্রায় ৬০ হাজার ভোটে হারান তৃণমূলের কানাই লাল আগরওয়াল-কে। সিপিএমের মহম্মদ সেলিম ১ লক্ষ ৮৩ হাজার ভোট পেয়ে তৃতীয় হন। দেবশ্রী চৌধুরী পেয়েছিলেন ৫ লক্ষ ১১ হাজার ভোট।

কে এগিয়ে-এই বিধানসভার সাতটির মধ্যে ৬টিতেই তৃণমূলের বিধায়ক আছে। একমাত্র কালিয়াগঞ্জে ২০২১ বিধানসভায় জিতেছিলেন বিজেপির সৌমেন রায়। অঙ্কের বিচারে এই লোকসভায় এগিয়ে তৃণমূলের কৃষ্ণ কল্যাণী। তবে কংগ্রেসের ভিক্টর বিজেপি বিরোধী ভোট কাটা শেষ অবধি সুবিধা করে দিতে পারে বিজেপি-র কার্তিক পালকে।