পার্থ প্রতিম চন্দ্র: আগামী সোমবার দেশের আটটি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের ৪৯টি লোকসভা আসনে ভোটগ্রহণ হতে চলেছে। উত্তর প্রদেশের ১৪টি, মহারাষ্ট্রের ১৩টি, পশ্চিমবাঙলার ৭টি, বিহার এবং ওডিশার পাঁচটি করে, ঝাড়খণ্ডের তিনটি ও জম্মু-কাশ্মীর ও লাদাখে দুটি লোকসভা আসনে ভোটগ্রহণ হতে চলেছে পঞ্চম দফায়। এবারের দফায় বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ আসনে ভোটগ্রহণ হতে চলেছে।
বাংলায় ভোটগ্রহণ হবে-সোমবার, ২০ মে ভোটগ্রহণ হবে- হুগলি জেলার ৩ টি কেন্দ্র: শ্রীরামপুর, হুগলি ও আরামবাগ। হাওড়া জেতার ২টি কেন্দ্র: হাওড়া ও উলুবেড়িয়া। উত্তর ২৪ পরগণার দুটি কেন্দ্র- ব্যারাকপুর ও বনগাঁ-য়।
এই দফাতেই ভোট দেবে মুম্বইবাসী। উত্তর প্রদেশের হাই প্রোফাইল দুই আসন-আমেথি ও রায়বারেলিতে সোমবার ভোট হবে। পাশাপাশি সেদিনই উত্তর প্রদেশের রাজধানী লখনৌ, ঝাঁসি, ফতেপুর, যৌন হেনস্থায় অভিযুক্ত ব্রিজ ভূষণ শরণ সিং-য়ের কেন্দ্র কাইসেরগঞ্জের মত নজরকাড়া আসনেও ভোটগ্রহণ হবে। মুম্বই ছাড়াও মহারাষ্ট্রের থানে, নাসিক, কল্যাণের মত গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ হবে। বিহারের শরণ লোকসভায় লালুপ্রসাদ যাদবের মেয়ে রোহিনি আচার্য-র ভাগ্যপরীক্ষা হবে। লালুর মেয়ে প্রার্থী হয়েছেন বিজেপির হেভিওয়েট তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রাজীবপ্রসাদ রুডির বিরুদ্ধে প্রার্থী।
কাশ্মীরের বারামুলায় নিশ্চিদ্র নিরাপত্তার মধ্যে হবে ভোটগ্রহণ। লাদাখের ঠান্ডায় এবার ভোটের হাওয়া এবার বেশ উষ্ণ। লাদাখে ভোট সোমবার।
সোমবার পঞ্চম দফায় নজরকাড়া দশ আসন--
১) রায়বারেলি (উত্তর প্রদেশ): রাহুল গান্ধী (কংগ্রেস) বনাম দীনেশ প্রতাপ সিং (বিজেপি)
কংগ্রেসের দুর্গ, বলা ভাল গান্ধী-গড়। একটা সময় দেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এখান থেকে কংগ্রেস প্রার্থী হয়ে জিতেছেন। ২০০৪ থেকে সোনিয়া গান্ধী রায়বারেলি থেকে দাঁড়িয়ে জিতে আসছিলেন। কিন্তু রাজ্যসভায় চলে যাওয়ায় সোনিয়া এবার রায়বারেলি থেকে ছেলে রাহুল গান্ধীকে প্রার্থী করেছেন। গতবার আমেথিতে হারা রাহুলের কাছে চ্যালেঞ্জের হল ইউপি-তে কংগ্রেসের শেষ দুর্গ রায়বারেলিতে হাত চিহ্ন বজায় রাখা।
২) আমেথি (উত্তর প্রদেশ): স্মৃতি ইরানি (বিজেপি) বনাম কেএল শর্মা (বকলমে প্রিয়াঙ্কা গান্ধী)
২০১৯ লোকসভার আগে পর্যন্ত আমেথি কংগ্রেসের দুর্গ হিসেবে পরিচিত ছিল। কিন্তু গতবার বিজেপি নেত্রী স্মৃতি ইরানির বিরুদ্ধে রাহুল গান্ধী-র হারে যোগী রাজ্যের আমেথিতেও গেরুয়া রঙে ঢেকেছে। এবার কংগ্রেসের কাছে চ্যালেঞ্জ স্মৃতিটুকু থাক বলে আমেথি উদ্ধারের। জল্পনা ছিল,হয় প্রিয়াঙ্কা গান্ধী বঢ়রা বা রাহুল গান্ধী আমেথি উদ্ধারে স্মৃতির বিরুদ্ধে লড়বেন। কিন্তু না, তেমনটা হয়নি। বরং লো প্রোফাইল গান্ধী পরিবার ঘনিষ্ঠ কেএল শর্মা-কেই কেন্দ্রীয় মন্ত্রী স্মৃতি ইরানির বিরুদ্ধে প্রার্থী করেছে কংগ্রেস। তবে প্রার্থী না হলেও আমেথি চষে বেরিয়ে স্মৃতির বিরুদ্ধে যেন প্রিয়াঙ্কাই লড়ছেন। এবার দেখার আমেথির ভোটাররা কোন দিকে রায় দেন।
৩) হুগলি (বাংলা): রচনা বন্দ্যোপাধ্যায় (তৃণমূল) বনাম লকেট চট্টোপাধ্যায় (বিজেপি)
হুগলিতে এবার দুই তারকা অভিনেত্রীর লড়াই। রচনা বনাম লকেট। দিদি নম্বর ওয়ানের ক্রেজ বনাম লকেটের লড়াই। যে হুগলির সিঙ্গুরের আন্দোলন থেকে রাজ্য় রাজনীতিতে মমতা বন্দ্য়োপাধ্যায়ের সিংহাসন প্রাপ্তি হয়েছে, সেই হুগলি গত লোকসভায় হাতছাড়া হয় দিদির। এবার হুগলি পুনরুদ্ধারে দিদির বাজি 'দিদি নম্বর ওয়ান'। জনপ্রিয় অভিনেত্রী-সঞ্চালিকা রচনা বন্দ্যোপাধ্যায় বিজেপির জয়ের লকেট ছিনিয়ে নিতে গত কয়েক দিনে পরিশ্রম করেছেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় কিছু বিতর্কিত মন্তব্যে রচনা ভাইরাল হয়েছেন। তবে দিদি নম্বর ওয়ানকে হাতের সামনে পেয়ে হুগলির মহিলারা যে ভালাবাসা দিচ্ছেন তা ধরা পড়ছে।
সেখানে গতবার রত্না দে নাগ-কে হারিয়ে হুগলিতে পদ্ম ফোটানো লকেটের সামনে এবার বড় চ্যালেঞ্জে তৃণমূলের রচনা লেখার সুযোগ না দেওয়া। ২০১৯ বিধানসভা দাঁড়িয়ে চুঁচুড়ায় লজ্জার হারের মুখে পড়তে হয়েছিল লকেট-কে। লকেটের এবার অগ্নিপরীক্ষা।
৪) মুম্বইয়ের ৬টি আসন: বিজেপি+শিন্ডে সেনা+অজিত পাওয়ার এনসিপি বনাম কংগ্রেস+ উদ্ভব সেনা+ শরদ পাওয়ার এনসিপি
মায়ানগরী মুম্বইয়ে মোট ৬টি লোকসভা আসন আছে। সেগুলি হল- ১) মুম্বই উত্তর, ২) মুম্বই উত্তর পূর্ব, ৩) মুম্বই উত্তর পশ্চিম, ৪) মুম্বই উত্তর-মধ্য বা নর্থ সেন্ট্রাল, ৫) মুম্বই সেন্ট্রাল বা মধ্য ও ৬) মুম্বই দক্ষিণ। বিজেপি ও একনাথ শিন্ডের শিবসেনার সঙ্গে মুখোমুখি লড়াই বিজেপি, উদ্ভব ঠাকরে জোটের। বলিউড নগরীতে এবার লড়াই হাড্ডাহাড্ডি।
৫) লখনৌ (উত্তর প্রদেশ): রাজনাথ সিং (বিজেপি) বনাম রবিদাস মেহরোতা (এসপি)
বিজেপি-র নিশ্চিত আসন। ১৯৯১ থেকে লখনৌ লোকসভায় বিজেপি টানা অনায়াসে জিতে আসছে। ১৯৯১ থেকে ২০০৪- লোকসভায় লখনৌ লোকসভায় জিতেছেন ভারতরত্ন তথা ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী। বাজপয়ীর পর বিজেপির টিকিটে লখনৌ লোকসভায় জিতে সাংসদ হয়েছিল লাল জি ট্যান্ডন। এরপর মোদী দিল্লিতে আসার পর ২০১৪ ও ২০১৯ লোকসভা লখনৌয়ে প্রার্থী হয়ে জিতেছেন কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং। তবে গতবার শত্রুঘ্ন সিনহা-র স্ত্রী পুণম সিনহা-র বিরুদ্ধে সহজ জয় পেলেও এবার তুলনায় রাজনাথের জেতার কাজটা কঠিন বলে মনে করা হচ্ছে।
৬) ব্যারাকপুর (বাংলা): অর্জুন সিং (বিজেপি) বনাম পার্থ ভৌমিক (তৃণমূল):
নির্বাচন যুদ্ধে এখনও পর্যন্ত অপরাজিত অর্জুন সিং। বাম আমলে সিপিএমের শক্ত জমিতে তিনি কাস্তে হাতুড়িকে হারিয়েছেন। মোদী ঝড়ের মাঝেও ভাটপাড়ায় অনায়াসে তৃণমূলের টিকিটে জিতেছিলেন। আবার বিজেপি-তে গিয়ে দিদির মজবুত গড় হিসেবে পরিচিত ব্যারাকপুরে তৃণমূল-কে হারিয়েছেন। অপরাজিত অর্জুনের রথের চাকা আটকানোর চ্যালেঞ্জ মমতার সারথী পার্থ ভৌমিকের। গতবার তৃণমূলের টিকিট না পেয়ে বিজেপি-র টিকিটে দাঁড়িয়ে দিদির প্রার্থী দীনেশ ত্রিবেদী-কে হারিয়ে অঘটন ঘটিয়েছিলেন অর্জুন সিং। এবারও ব্যারাকপুরে লক্ষ্যভেদ করতে পারবেন কি ঠিক গতবারের মত নাটকীয়ভাবে বিজেপি প্রার্থী হয়ে দাঁড়ানো অর্জুন? এবার অর্জুনের সামনে রাজ্যের মন্ত্রী তথা নৈহাটির বিধায়ক পার্থ ভৌমিক।
৭) শরণ (বিহার): রাজীব প্রসাদ রুডি (বিজেপি) বনাম রোহিনী আচার্য (আরজেডি)
বিহারের লালু গড় হিসেবে পরিচিত এই কেন্দ্রে আরজেডি-র প্রার্থী লালুপ্রসাদ যাদবের মেয়ে রোহিনী আচার্য। রোহিনী তাঁর বাবা লালু প্রসাদ যাদব-কে একটি কিডনি দান করেছিলেন। সরণে নীতীশের দলের ভোট ভালই রয়েছে। জেডি (ইউ)-য়ের ভোট বিজেপির বাক্সে না পড়লে লালু গড়ে ১০ বছর পর লণ্ঠন জ্বলতে পারে। ২০০৯ লোকসভায় শরণ থেকে জিতেছিলেন খোদ লালুপ্রসাদ যাদব। কিন্তু লালু গড়ে দশ বছর ধরে পদ্মে ফুটছে। গত দুটি লোকসভা নির্বাচনে এখান থেকে জেতেন বিজেপি-র রাজীব প্রসাদ রুডি। ২০১৪ লোকসভায় লালু পত্নী রাবড়ি দেবীকে ৪০ হাজার ভোটে হারান রাজীব। আর ২০১৯ লোকসভায় পদ্ম প্রার্থী রাজীব জেতেন ১ লক্ষ ৩০ হাজার ভোটে। কিন্তু এবার বিজেপিকে হারাতে আদাজল খেয়ে নেমেছেন তেজস্বী। মেয়ে রোহিনিকে জেতাতে এই বয়েসেও প্রচারে নামেন লালু।
৮) লাদাখ (লাদাখ): তাশি গেলসান (বিজেপি) বনাম সেরিং নামগেল (কংগ্রেস)
ভোটের মুখে লাদাখের পরিবেশ ও লাদাখবাসীকে বঞ্চনার প্রতিবাদে নরেন্দ্র মোদীর সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমেছিলেন বিখ্যাত পরিবেশবিদ সোনাম ওয়াংচুক। তারপর থেকেই লাদাখে এবার কিছুটা কোণঠাসা বিজেপি। এবার গতবারের সাংসদকে টিকিট দেয়নি বিজেপি। লাদাখে এবার লড়াই জমজমাট। ২৮ বছর পর লাদাখে জেতার স্বপ্ন দেখছে কংগ্রেস।
৯) হাজিপুর (বিহার): চিরাগ পাসোয়ান (এলজেপি) বনাম শিব চন্দ্র রাম (আরজেডি)
রাষ্ট্রীয় লোকশক্তি পার্টির প্রতিষ্ঠাতা তথা প্রয়াত কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রামবিলাস পাসোয়ানের গড়। পাসোয়ানের পার্টি আরএলপি ভেঙে দু ভাগ হয়ে গিয়েছে। এক ভাগ নিয়েছে রামবিলাসের ছেলে চিরাগ পাসোয়ান, অন্যভাগটা নিয়েছেন তাঁর ভাই পশুপতি কুমার পরশ। এবার হাজিপুরে চিরাগ না পশুপতি পরশ কে প্রার্থী হবেন তা নিয়ে দীর্ঘ লড়াই চলে। গত লোকসভায় হাজিপুর থেকে দাঁড়িয়ে বড় ব্যবধানে জিতেছিলেন পশুপতি কুমার পরশ। তবে জোটসঙ্গী বিজেপি শেষ পর্যন্ত চিরাগ পাসোয়ানকে সমর্থন করায় শুরুতে বিদ্রোহ করেও পরে পিছিয়ে এসে রণেভঙ্গ দেন পশুপতি কুমার পরশ। এবার চিরাগ নেভাতে লালুর দলের বাজি শিব চন্দ্র রাম। ১৯৮৯ থেকে হাজিপুরে জিতে আসছেন রামবিলাস পাসোয়ান, পরে গতবার জেতেন পশুপতি কুমার পরশ। এই লোকসভার রাঘোপুর বিধানসভার বিধায়ক হলেন আরজেডি-র প্রধান তথা বিহার বিধানসভার প্রধান বিরোধী দলনেতা তেজস্বী যাদব।
১০) কাইসেরগঞ্জ (ইউপি): করণ ভূষণ সিং(বিজেপি) বনাম রাম ভগত সিং (এসপি)
দেশের মহিলা কুস্তিগীরদের যৌন হেনস্থা কাণ্ডে গ্রেফতারের মুখে দাঁড়িয়ে বিজেপি নেতা ব্রিজভূষণ শরণ সিং। এই কাইসেরগঞ্জ থেকেই বাহুবলী নেতা ব্রিজভূষণ দু বার বিজেপির টিকিটে জিতে সাংসদ হয়েছেন। যৌন হেনস্থা কাণ্ডে চার্জশিটে নামা থাকায় ব্রিজভূষণকে প্রার্থী করেনি বিজেপি। তবে তাঁর পাশেই দল আছে এটা বোঝাতে ব্রিজভূষণের ছেলে করণ ভূষণ সিং-কে। এই কেন্দ্রে সমাজবাদী পার্টির প্রার্থী রাম ভগত সিং। মায়াবতী দাঁড় করিয়েছেন নরেন্দ্র পাণ্ডেকে।