পার্থ প্রতিম চন্দ্র: নির্বাচনে হেভিওয়েট-দের বিরুদ্ধে লড়া কি আর চারটি খানি কথা। নিশ্চিত হার কিংবা অসম্ভব কঠিন যুদ্ধক্ষেত্র জেনেও তারা লড়েন। আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে দেশের এমন আধডজন লোকসভা আসন আছে যা হেভিওয়েট প্রার্থীদের জন্য আলোচনায়। কিন্তু হেভিওয়েটদের কথা বলতে গিয়ে অনেকেই ভুলে যান, তাদের প্রতিপক্ষদের কথা বলতে।
আসুন দেখে নেওয়া যাক এবারের লোকসভা নির্বাচনে প্রকৃত অর্থে হেভিওয়েট প্রার্থীদের বিরুদ্ধে লড়তে চলা প্রার্থীদের কথা--
১) অজয় রাই (কংগ্রেস): বারাণসী কেন্দ্রে, নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে প্রার্থী।।
জয়ের সম্ভাবনা ১০ শতাংশ।
শেষবার ২০০৪ লোকসভায় বারাণসীতে কংগ্রেস প্রার্থী জয়লাভ করেছিলেন। জিতেছিলেন রাজেশ মিশ্র।
প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ভোটে লড়া। সে কী আর চারটি খানি কথা। প্রাক্তন আরএসএস কর্মী তথা বাহুবলী নেতা অজয় রাই এবারও কংগ্রেসের টিকিটে লড়বেন। মোদীর বিরুদ্ধে বারাণসী কেন্দ্র থেকে লড়বেন। গত দুটো লোকসভা ভোটে মোদীর বিরুদ্ধে লড়ে তৃতীয় হয়েছিলেন ইউপি কংগ্রেসের সভাপতি অজয় রাই। ডেভিড বনাম গোলিয়াথের লড়াইয়ে নেমে অজয় এবার বলছেন, মানুষই শেষ কথা বলবে। তিনি জাতিতে ভূমিহার ব্রাহ্মণ। ভূমিহাররা বেশির ভাগই পূর্ব উত্তরপ্রদেশ এবং বিহারের বাসিন্দা। অজয়ের রাজনৈতিক জীবনের খাতেখড়ি হয়েছিল বিজেপি-র অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদে। ২০০৯ সালে বিজেপি-র রাজ্য নেতাদের সঙ্গে বিবাদের পর তিনি দল ছেড়ে সমাজবাদী পার্টিতে যোগ দেন। তিন বছর পর কংগ্রেসে যোগ দেন। ২০১৪ লোকসভা নির্বাচনে মোদীর বিরুদ্ধে বারাণসীতে কেজরিওয়ালের পিছনে তৃতীয় হন অজয়। এরপর ২০১৯ লোকসভায় মোদীর বিরুদ্ধে এসপি-র শালিনী যাদবের পিছনে তৃতীয় হন তিনি। এবার মোদীর বিরুদ্ধে বিএসপি প্রার্থী দিয়েছে আথর জামাল লারি-কে। মোদীর সঙ্গে ছায়াযুদ্ধে অজয়ের লক্ষ্য হল দ্বিতীয় হওয়ার চেষ্টা।
২) সোনাল প্যাটেল (কংগ্রেস): গান্ধীনগর কেন্দ্রে, অমিত শাহ-র বিরুদ্ধে প্রার্থী।।
জয়ের সম্ভাবনা ৮ শতাংশ।
শেষবার গান্ধীনগরে কংগ্রেস জিতেছিল ১৯৮৪ লোকসভা নির্বাচনে
গান্ধীনগরে বিজেপির ঘাঁটি বললেও কম বলা হয়। গুজরাটের এই আসনে পদ্ম প্রতীকটাই শেষ কথা বলে। লালকৃষ্ণ আদবানি একান থেকে ১৯৯৮ নির্বাচন থেকে টানা পাঁচবার জিতেছিলেন। ২০১৯ লোকসভায় আদবানীর পরিবর্তে লড়ে অনায়াসে জয় পেয়েছিলেন অমিত শাহ। ১৯৯৬ লোকসভায় গান্ধীনগর থেকে দাঁড়িয়ে জিতেছিলেন অটল বিহারী বাজপেয়ী। এবার অমিত শাহ-র বিরুদ্ধে কংগ্রেস প্রার্থী করেছে স্থানীয় নেত্রী সোনাল প্যাটেল-কে। ৬০ বছরের সোনাল প্যাটেল লড়াকু নেত্রী হিসেবে পরিচিত। ২০১৮ গুজরাট বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের দুর্দান্ত ফলের সময় সোনাল প্যাটেল রাজ্যের মহিলা কংগ্রেসের সভানেত্রী ছিলেন। এআইসিসি সচিব সোনাল প্যাটেল নারায়নপুরার কাউন্সিলর। অমিত শাহ-কে কঠিন প্রতিপক্ষ মানছেন না তিনি। তবে হিসেব অন্য কথা বলছে, গতবার শাহ জিতেছিলেন ৫ লক্ষ ৩১ হাজার ভোটে। এবার সেটা ৬ লক্ষের ওপরে রাখতে চান কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। কিন্তু সোনাল হার ছাড়ছেন না।
৩) আন্নে রাজা (সিপিআই) ও কে সুন্দরান (বিজেপি): ওয়েনাড় কেন্দ্রে, রাহুল গান্ধীর বিরুদ্ধে প্রার্থী।।
জয়ের সম্ভাবনা ১০ শতাংশ।
গত লোকসভা নির্বাচনে কেরলের ওয়েনাড় থেকে রাহুল জিতেছিলেন রাজ্যের মধ্যে রেকর্ড ৪ লক্ষ ৩১ হাজার ভোটে। এবার রাহুলের পরিবর্তে সিপিআই দাঁড় করিয়েছে জাতীয় মহিলা ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক আন্নে রাজা-কে। রাহুলের বিরুদ্ধে এখানে বিজেপি দাঁড় করিয়েছে কেরলে দলের সভাপতি কে সুন্দেরান-কে। রাহুলের বিরুদ্ধে প্রতিপক্ষরা বেশ ওজনদার। তবে ২০০৯ লোকসভা থেকে কংগ্রসে এখানে জিতে আসছে। যদিও ২০১৪ লোকসভায় কংগ্রেস প্রার্থী এমআই শানভাস মাত্র ২১ হাজার ভোটে জিতেছিলেন সাইথান মোকেরির বিরুদ্ধে। বিজেপি প্রার্থী সেবার ৪০ হাজার ভোট পেয়েছিলেন।
৪) অভিজিৎ দাস (ববি) (বিজেপি): ডায়মন্ড হারবার লোকসভায়, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে প্রার্থী।।
জয়ের সম্ভাবনা ১৫ শতাংশ।
শেষবার ডায়মন্ড হারবারে বিরোধীরা জিতেছিল ২০০৪ লোকসভায়। সেবার জিতেছিলেন সিপিএমের শমিক লাহিড়ি।
বাংলায় একেবারে শেষ তৃণমূলের নম্বর টু অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে প্রার্থী ঘোষণা করল বিজেপি। অনেক নাম ফোরাফেরা করলেও শেষ অবধি দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার বিজেপি সভাপতি আইনজীবী অভিজিৎ দাস (ববি)-কে প্রার্থী করল পদ্ম শিবির। এর আগে ২০১৪ লোকসভাতেও অভিষেকের বিরুদ্ধে ববি ছিলেন পদ্ম প্রার্থী। সেবার ২ লক্ষ ৮৫৮টি ভোট পেয়ে তৃতীয় হয়েছিলেন তিনি। ১৪ নির্বাচনে ডায়মন্ড হারবারে দ্বিতীয় হয়েছিলেন সিপিএমের আবুল হাসনাত (৪ লক্ষ ৩৭ হাজার ভোট)। ববি এর আগে রেলের যাত্রী সুরক্ষা-স্বাচ্ছন্দ্য কমিটির সদস্য ছিলেন। এবার অভিষেকের বিরুদ্ধে বাম প্রার্থী ছাত্রনেতা প্রতীক উর। প্রতীক প্রচারে সাড়া ফেলছেন। দ্বিতীয় হওয়ার জোর লড়াই হতে পারে বিবি বনাম প্রতীকের বিরুদ্ধে। গতবার ৩ লক্ষ ২০ হাজার ভোটে জেতা অভিষেকের নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন বিজেপির নীলাঞ্জন রায় (৪ লক্ষ ৭০ হাজার ভোট)। সেখানে তৃতীয় হওা সিপিএমের ফুয়াদ হালিম মাত্র ৯৩ হাজার ভোট পেয়েছিলেন।
৫) বিকাশ ঠাকরে (কংগ্রেস) : নাগপুর কেন্দ্রে, নীতীন গডকরির বিরুদ্ধে প্রার্থী।।
জয়ের সম্ভাবনা ২০ শতাংশ।
শেষবার নাগপুরে কংগ্রেস জিতেছিল ২০০৯ লোকসভায়
আরএসএস-র গড় নাগপুরে গত দুটি লোকসভা নির্বাচনে অনায়াসে জিতেছিলেন কেন্দ্রীয় সড়ক পরিবহন-জাতীয় সড়ক মন্ত্রী নীতীন গডকরি। তবে নাগপুরে একটা সময় ভাল জায়গায় ছিল কংগ্রেস। এখনও এই লোকসভার দুটি বিধানসভায় কংগ্রেসের বিধায়ক আছে। তার মধ্যে নাগপুর পশ্চিমের বিধায়ক বিকাশ থাকরে এবার গডকরির বিরুদ্ধে কংগ্রেসের টিকিটে দাঁড়িয়েছেন। নাগপুর জেলা কংগ্রেস কমিটির সভাপতি বিকাশ এলাকায় খুব পরিচিত ও জনপ্রিয়। গত লোকসভায় মহারাষ্ট্র কংগ্রেসের সভাপতি নানা পাটোলেকে ২ লক্ষ ১৬ হাজার ভোটে হারিয়েছিলেন গডকরি। তার আগে ২০১৪ নির্বাচনে কেন্দ্রীয় সড়ক মন্ত্রী জিতেচিলেন ২ লক্ষ ৮৫ হাজার ভোটে। এবার সেখানে বিকাশ কতটা লড়াই দেন সেটা দেখার।
৬) রবিদাস মালহোত্রা (সমাজবাদী পার্টি): লখনৌ লোকসভায়, রাজনাথ সিংয়ের বিরুদ্ধে।।
জয়ের সম্ভাবনা ২৫ শতাংশ।
শেষবার লখনৌ-য়ে কংগ্রেস জিতেছিল ১৯৮৪ লোকসভা নির্বাচনে
যোগী আদিত্যনাথের রাজ্যের রাজধানী লখনৌ পুরোপুরি বিজেপি-র ঘাঁটি। এখানে বিজেপির হার মানে গোটা দেশে দলের বিপর্যয়। যদিও এই লোকসভার পাঁচটি বিধানসভার মধ্যে দুটি-তে সমাজবাদী পার্টির বিধায়ক আছে, আরেকটিতে এসপি-র সংগঠন গত এক বছরে বেশ মজবুত হয়েছে। কিন্তু প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিংয়ের ব্যক্তিগত ক্যারিশ্মা কাজ করে এখানে। রাজনাথের বিরুদ্ধে অখিলেশ যাদবের এসপি প্রার্থী রবিদাস মালহোত্রা রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী ছিলেন। লখনৌ সেন্ট্রাল কেন্দ্রের বিধায়ক রবিদাস তাঁর কেন্দ্রে খুব জনপ্রিয়।
*এই কপিতে লেখা জয়ের সম্ভাবনার হিসেব বের করা হয়েছে, সেই কেন্দ্রে তার দল শেষ কবে জিতেছে, শেষ বিধানসভা ভোটে সেই কেন্দ্রের ফলাফল কেমন ছিল। গত লোকসভায় ভোটে জয়-পরাজয়ের ব্যবধান কত ছিল। এবার হাওয়া কেমন। প্রচার কেমন। তার ওপর ভিত্তি করে।