হলিউড সিনেমার চিত্রনাট্যকেও হারা মানাবে এই খবর। দেশে কাজ নেই। পকেটে খালি। খিদে পেটে আর কত দিনই বা থাকা যায়। তাই ওরা চারজন ঠিক করল বিদেশে পালাবে। সেখানে আর যাই হোক, দু বেলা বেঁচে থাকার মত খাবার কিছু তো জুটবে। বন্দরে এসে নিরাপত্তারক্ষীদের চোখে ধুলো দিয়ে ওরা লুকিয়ে একটা পণ্যবাহী (Cargo Ship) বিদেশী জাহাজের সামনে হালে (rudder) লুকিয়ে থাকে। ওদের পরিকল্পনা ছিল জাহাজ ছাড়লে লুকিয়ে ওরা ভিতরে ঢুকে পড়বে। কিন্তু সেটা সম্ভব হয়নি। জাহাজের এমন জায়গাটায় ওরা ছিল, যাতে সেটা চলতে শুরু করলে সেখান থেকে জলে ঝাঁপ দেওয়া ছাড়া আর উপায় থাকে না।
এরপর টানা ১৪ দিন জাহাজের সামনে কোনওরকমে ঝুঁকি নিয়ে আটলান্টিক মহাসাগরের প্রবল স্রোত, ঝড়-বৃষ্টি মাথায় করে ভাসতে ভাসতে ব্রাজিলে এসে পড়ে ওরা। ওদের সঙ্গে যে খাবার, পানীয় জল ছিল তা দশম দিনে এসেই শেষ হয়। সফরের শেষ চারটে দিন ওরা সমুদ্রের নোনতা জল পান করে ও পুরো অনাহারেই ছিল। ব্রাজিলের ভিটোরিয়ার বন্দরে ঢোকার মুখে ওদের দেখে ফেলে পুলিশ ও নিরাপত্তারক্ষীরা। ওদের কাণ্ড দেখে সবাই অবাক। ১৪ দিনে ওরা পুরো ৫৬০ কিলোমিটার (৩৫০০ মাইল) জলপথ অতিক্রম করে। আরও পড়ুন-ইউক্রেনের রক্তদান কেন্দ্রে বোম ছুড়ল রাশিয়া, পুতিনের দেশের ব্রিজ ভাঙল জেলেনস্কিরা
ওই চার নাইজেরিয়ানের বক্তব্য হল, তারা ভেবেছিল এই জাহাজে চড়ে নাইজেরিয়া থেকে ওরা ইউরোপের কোনও দেশ বা ইংল্যান্ডে যাবে। কিন্তু শেষ অবধি তারা ব্রাজিলে এসে পড়েছে শুনে ওরাই তাজ্জব বনে যায়। ওদের মধ্যে একজন বলল, জাহাজের সামনে ইংরেজিতে লেখা দেখে ওরা ভেবেছিল জাহাজটা ইউরোপ বা ইংল্যান্ডে যাবে। ১৪ দিনের সফরটা অনেক শিক্ষা দিয়েছে ওদের। এতটা কষ্ট হয়েছে, এমনটা যেন কেউ না করে। আর জীবন থাকতে কোনওদিন এমন করবে না বলেও জীবন বাজি রাখা সফর শেষে বলল নাইজেরিয়ানরা। একটা সময় ওরা ভেবেছিল ঝড়, আর সমুদ্রের সুবিশাল ঢেউয়ে মারা যাবে। কিন্তু জীবনে বাঁচার ইচ্ছা ওদের মরতে দেয়নি।
ব্রাজিলের ভিটোরিয়া বন্দরের পুলিশ ওদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেনি। গত ২৭ জুন লাগোসে ওরা জাহাজে উঠেছিল। তিন চারদিন পর থেকে মহাসাগর এত উত্তাল হয়ে পড়ে যে ওদের মনে হয়েছিল সব শেষ হয়ে যাবে। রাতের মহাঢেউগুলো ওদের ক্লান্ত করে দিত। গোটা গায়ে কাটা দাগ, রক্তাক্ত হয়ে যায় ওরা। তবু ওরা হাল ছাড়েনি। শেষ অবধি ১৪ দিনের সফরটা ওদের শেষ হল জীবনকে জিতিয়ে।
দেখুন ভিডিয়ো
These men travelled from Nigeria to Brazil sitting on a ship's rudder for 14 days 👇 pic.twitter.com/wZWJxIUqsV
— Al Jazeera English (@AJEnglish) August 5, 2023
কিন্তু কেন নাইজেরিয়া ছাড়তে হল? ওরা বলছে, তাদের দেশে কোনও কিছুই ঠিক নেই। অর্থনীতি ভেঙে পড়েছে। হাতে গোণা কয়েকজন ছাড়া সবাই বেকার, দুর্নীতিতে ভরে গেছে দেশ। ওদের পরিবারের সবাই কাজের খোঁজে সব আলাদা হয়ে গিয়েছে। আর তাই জীবনে বাঁচতে অন্য দেশে পাড়ি দেওয়ার পরিকল্পনা করেন ওরা। চারজনের মধ্যে থেকে ব্রাজিল থেকে দু জন তাদের দেশে ফিরে গিয়েছেন। রোমান ও থ্যাঙ্কগড নামের দুই নাইজেরিয় যুবক ব্রাজিলিয়ান সরকারের কাছে আশ্রয় চেয়ে সেখানে থাকা আবেদন জানিয়েছে।
আফ্রিকা থেকে সাগর পেরিয়ে ইউরোপ আসার ঘটনা গত কয়েক বছর বারবার শোনা যাচ্ছে। গত ৬ মাসে অবৈধভাবে সাগর পেরিয়ে স্পেনে ঢুকতে গিয়ে হাজারের কাছাকাছি অভিবাসন প্রত্যাশীর মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু এভাবে জাহাজের হালে বসে লুকিয়ে যাওয়ার ঘটনা শোনা যায়নি। ২০২৩ সালের প্রথম ৬ মাসে ১৪টি দেশের নাগরিকরা সমুদ্র পাড়ি দিয়ে স্পেনে যাওয়ার চেষ্টা করেন। দেশগুলো হলো- আলজেরিয়া, ক্যামেরুন, কমোরোস, কঙ্গো গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র, ইথিওপিয়া, গিনি, আইভরি কোস্ট, মালি, মরক্কো, গাম্বিয়া, সেনেগাল, সুদান, সিরিয়া, গাম্বিয়া ও এশিয়ার দেশ শ্রীলঙ্কা।