পার্থ প্রতিম চন্দ্র: একটা সময় আলিপুরদুয়ার মানেই ছিল বেলচা-কোদাল। কিন্তু বেলচা কোদালে জং ধরতেই পদ্মে ছেয়ে গিয়েছে এই লোকসভা কেন্দ্র। আরএসপি-র শক্ত ঘাঁটি আলিপুরদুয়ার-কে এখন অনায়াসে পদ্মগড় বলা চলে। ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনে গোটা রাজ্যে দিদি ঝড়ে উড়ে গিয়েছিল বিজেপি। কিন্তু উজ্জ্বল ব্যতিক্রম ছিল আলিপুরদুয়ার। এই লোকসভার সব কটা বিধানসভা আসনেই জিতেছিল বিজেপি। এবার লোকসভা ভোট। জন বার্লা-কে টিকিট না দিয়ে মাদারিহাটের দু বারের বিধায়ক মনোজ টিগ্গা-কে প্রার্থী করে বিজেপি নিশ্চিত আলিপুরদুয়ারে তারা আবার জিততে চলছে। এই গেরুয়া আত্মবিশ্বাসের বেশ কিছু কারণ আছে।
জন বার্লা-কে প্রার্থী না করার পিছনে সবচেয়ে বড় কারণ ছিল, বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব নিশ্চিত দলের সংগঠন এখানে জয় নিশ্চিত করবে, কোনও ব্যক্তি গুরুত্ব দেওয়ার কারণ নেই। কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার ও জলপাইগুড়ির জেলা নিয়ে তৈরি এই লোকসভা আসনে গতবার বিজেপি জিতেছিল আড়াই লক্ষের কাছাকাছি ব্যবধানে। তবে জয় নিশ্চিত মনে করলেও বিজেপি-র অনেক নেতার ধারনা জয়ের ব্যবধান এবার কমবে। আর এই মনে করার পিছনে সবচেয়ে বড় কারণ তৃণমূল প্রার্থী প্রকাশ চিক বারিক। প্রকাশ এবার ভোট প্রচারে সাড়া ফেলতে পেরেছেন। গত বছর দল তাঁকে রাজ্যসভায় জিতিয়ে এনেছিল। আর এবার দিদি তাঁকে জনতার দুয়ারে ঠেলে দিয়েছেন। লড়াই বেশ কঠিন। তবু চ্যালেঞ্জটা তিনি নিয়েছেন।
কোথায় খেলা ঘুরেছে
২০১৬ বিধানসভায় আলিপুরদুয়ার লোকসভার ৬টি বিধানসভাতেই জিতেছিল তৃণমূল, একমাত্র মাদারিহাটে জিতেছিলেন বিজেপি-র মনোজ টিগ্গা। কিন্তু ২০১৯ লোকসভায় জয়ের পর ২০২১ বিধানসভায় ই জেলায় খেলা ঘুরিয়ে দেয় বিজেপি। তৃণমূলের দাবি, তারা আবার পুরনো জমি ফেরাতে পেরেছে।
অঙ্ক কী বলছে--
আলিপুরদুয়ার লোকসভায় যে সাতটি বিধানসভা আছে সেগুলি হল- ১) মাদারিহাট, ২) নাগরাকাটা, ৩) ফালাকাটা, ৪) আলিপুরদুয়ার, ৫) কালচিনি, ৬) কুমারগ্রাম ও ৭) তুফানগঞ্জ। বিজেপি প্রার্থী মনোজ টিগ্গা মাদারিহাট থেকে গত বিধানসভায় জিতেছিলেন প্রায় ৩০ হাজার ভোটে। আলিপুরদুয়ার জেলার পাঁচটি আসন-কুমারগ্রাম, কালচিনি, আলিপুরদুয়ার, ফালাকাটা, মাদারিহাটে বিজেপির সংগঠন বেশ মজবুত। জলপাইগুড়ি জেলায় নাগারাকাটায় অবশ্য তৃণমূল কিছুটা হলেও ঘুরে দাঁড়িয়েছে।কোচবিহারে তুফানগঞ্জে এবার হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। অঙ্কের হিসেবে এগিয়ে বিজেপি।
কী হলে বিজেপির জয় নিশ্চিত
আলিপুরদুয়ার ছিল বামফ্রন্টের শরিক আরএসপি-র ঘাঁটি। আরএসপি-র ভোটের প্রায় সবটাই বিজেপি-তে চলে গিয়েছে। এবারও সেটা হলে পদ্মগড় অটুট থাকবে।
কী হলে তৃণমূল জিততে পারে
২০১৪ লোকসভায় আলিপুরদুয়ারে তৃণমূলের দশরথ তিরকে ১৯ হাজার ভোটে হারান মনোহর তিরকে-কে। সেই ভোটে মনোহর তিরকে ৩ লক্ষ ৪১ হাজার ভোট পেয়েছিলেন, আর তৃতীয় হওয়া বিজেপি প্রার্থী বীরেন্দ্র ওরাঁও পান ৩ লক্ষ ৩৫ হাজার ভোট। কিন্তু পাঁচ বছর পর আরএসপি এখানে মাত্র ৫৪ হাজার ভোট পায়। আরএসপি-র ভোটব্যাঙ্কের কমে যাওয়া প্রায় ২ লক্ষ ৮০ হাজার ভোট চলে যায় বিজেপি-তে। ২০১৯ লোকসভায় বিজেপির জন বার্লা পান সাড়ে ৭ লক্ষ ভোট। তৃণমূলকে এবার জিততে হলে আরএসপি-র ভোট ব্যাঙ্কের দিকে ভরসা করতে হবে। তৃণমূলকে ভাল ফল করতে হলে আলিপুরদুয়ার জেলার অন্তত তিনটি বিধানসভায় বড় লিড পেতে হবে।
আরএসপি-র প্রত্যাবর্তন সম্ভব?
১৯৭৭ থেকে আলিপুরদুয়ার লোকসভা তৈরির সময় থেকে এখানে জিতে আসছে আরএপসি। পিযুষ তিরকে টানা পাঁচটা লোকসভা নির্বাচন জেতার পর ১৯৯৬ থেকে জোয়াকিম বাক্সালা টানা চারটে ভোটে জিতে সাংসদ হন। ২০০৯ লোকসভায় আরএসপি-র টিকিটে জেতেন মহোর তিরকে। ২০১৪ লোকসভায় প্রথম আলিপুরদুয়ার লোকসভায় আরএসপি-র বাইরে কোনও দল জয়ী হয়। সেবার মনোহর তিরকেকে হারান তৃণমূলের দশরথ তিরকে। একটা সময় বলা হতো, আলিপুরদুয়ারের মানুষ আরএসপি ছাড়া কোনও পার্টির নাম শোনেনি। সেখানেই এখন পদ্মগড়। আরএসপি-র সংগঠন এখানে ভেঙে পড়েছে। গতবার মাত্র ৫৪ হাজার ভেট পাওয়া মিলি ওরাঁও-কেই টিকিট দিয়েছে RSP। আরএসপি এখানে অতীতের ছায়া। প্রত্যাবর্তনের তেমন সম্ভাবনা নেই। তবে বছর দুয়েক পর বিধানসভা নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে আলিপুরদুয়ারে ভোট বাড়াতে মরিয়া বাম শরিক।
২০১৯ লোকসভার ফল
জন বার্লা (বিজেপি): ৭ লক্ষ ৫০ হাজার ৮০৪টি ভোট
দশরথ তিরকে (তৃণমূল): ৫ লক্ষ ৬ হাজার ৮১৫টি ভোট
মিলি ওরাঁও (আরএসপি): ৫৪ হাজার ১০টি ভোট
মহোনলাল বাসুমন্ত (কংগ্রেস): ২৭ হাজার ৪৫২৭টি ভোট।
ফল-জন বার্লা (বিজেপি) জয়ী ২ লক্ষ ৪৩ হাজার ৯৮৯ ভোটে।
২০২৪ লোকসভায় প্রার্থীরা
মনোজ টিগ্গা (বিজেপি), প্রকাশ চিক বারিক (তৃণমূল), মিলি ওরাঁও (আরএসপি), চন্দন ওরাঁ (এসইউসিআই), নৃপেন্দ্র নারায়ণ দেবকার্জি (কেপিপি (ইউ))।
জানেন কী
২০০৯ লোকসভায় বিজেপির টিকিটে দাঁড়িয়ে মনোজ টিগ্গা ২ লক্ষের কাছাকাছি ভোট পেয়েছিলেন। তৃতীয় হলেও মনোজই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন আলিপুরদুয়ারে পদ্ম চাষ হতে পারে। সেই মনোজ এবার পদ্ম প্রার্থী।