এবারের আইপিএলে (IPL 2024) অবিশ্বাস্য ক্রিকেটে খেলে চ্যাম্পিয়ন হল কলকাতা নাইট রাইডার্স (Kolkata Knight Riders)। পুরো টুর্নামেন্ট জুড়েই নাইটদের ধারেকাছে আসতে পারল না কোনও দল। মাত্র তিনটে ম্যাচে হার ছাড়া আইপিএল ২০২৪-এ বাকি সব কটি খেলায় সব বিভাগেই বিপক্ষদের টেক্কা দেয় শ্রেয়স আইয়ারের দল। ফাইনালে তো সান রাইজার্স হায়দরাদ-কে দাঁড়াতে দিল না নাইটরা। আইপিএলের ইতিহাসে সবচেয়ে একপেশে ফাইনালে সান রাইজার্সকে মাত্র ১১৩ রানে অল আউট করার পর ৫৭ বল বাকি থাকতে জিতে নেন শ্রেয়স আইয়ার-রাও। কোয়ালিফায়ার ওয়ানেও কিছুটা একই কায়দায় প্যাট কামিন্সদের হারান মিচেল স্টার্ক-আন্দ্রে রাসেল-রা। সবার আগে প্লে অফে ওঠে, লিগের খেলায় সবার আগেও ছিল শাহরুখ খানের দল।
অথচ ক মাস আগে নিলামের পর প্রায় সব বিশেষজ্ঞই নাইটদের নতুন কেনা ক্রিকেটারদের নিয়ে নাক উঁচু করা কথা বলেছিলেন। অনেকেই বলেছিলেন, এবারের নিলামের পর খাতায় কলমে সবচেয়ে খারাপ দল দেখিয়েছে কলকাতার। কারণ নিলামে সবচেয়ে বেশী যাদেরক নিয়ে আলোচনা হয়েছিল, তাদের কাউকেই দলে পায়নি কলকাতা। কিন্তু এরপরে সব হিসেব উল্টে শাহরুখ খানের দল জিতল খেতাব।কিন্তু কীভাবে সম্ভব হল এটা?আসুন দেখে নেওয়া যাক নাইটদের খেতাব জেতার পিছনে পাঁচ কারণ--
১) রাসেল-নারিন যুগলবন্দি
গত আইপিএলের পর অনেকেই বলেছিলেন, আন্দ্রে রাসেল ও সুনীল নারিন-দের এবার ছেড়ে দিয়ে নিলামে এখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সফল ক্রিকেটারদের কেনা উচিত। নারিন, রাসেল-রা তেমন একটা ফর্মে ছিলেন না। কিন্তু নাইট কর্তৃপক্ষ সে সব না শুনে, নারিন ও রাসেল-কে দলে রেখে দেন। এবারের আইপিএলে সুনীল নারিন ব্যাট হাতে সেঞ্চুরি সহ বেশ কয়েকটি বিস্ফোরক ইনিংস খেলেন। ফিল সল্টের সঙ্গে ওপেনে নেমে নারিন দলের বাকি ব্যাটার-দের ওপর বোঝা কমিয়ে দিয়েছিলেন। আর বল হাতে তাঁর চার ওভারের স্পেল তো এবারও মাতিয়ে দিয়েছে। আন্দ্রে রাসেলের ফিটনেস নিয়ে প্রশ্ন ছিল। কিন্তু বল হাতে ১৯ উইকেট, আর ব্যাট হাতে অবিশ্বাস্য বিস্ফোরক ইনিংস খেলে রাসেল-ই এবারের আইপিএলের সবচেয়ে কার্যকরী নাইট বনে যান।
২) গম্ভীরের মস্তিষ্ক:
গৌতম গম্ভীর-কে যে কোনও মূল্যে নাইট রাইডার্সের কোচিং স্টাফে ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলেন। গম্ভীরের নেতৃত্বেই কলকাতা দু বার আইপিএল জিতেছিল। কিন্তু এরপর কিছুতেই খেতাব আসছিল না। শাহরুখ ঘনিষ্ঠ মহলে বারবার বলছিলেন, গোতিকেই নাইটদের ডাগ আউটে ফেরাতেই হবে। সেই মত গত বছর গম্ভীরের সঙ্গে শাহরুখের দশ মিনিটের একটা ফোন কলই সব জট কেটেছিল। নাইট রাইডার্সে মেন্টর হিসেবে ফেরার পরই নীতীশ রানা-র হোয়াটসঅ্যাপের জবাবে গম্ভীর শুধু বলেছিলেন, ট্রফি হাতে পোডিয়ামে উঠে উপভোগ করা যাক। গম্ভীরের ঠান্ডা মাথায় ক্রিকেটীয় মস্তিষ্কটা এবার বড় ফ্যাক্টার হল।
৩) অধিনায়ক শ্রেয়স আইয়ার:
এর আগে দিল্লি ক্যাপিটালসকে ফাইনালে তুলে চমকে দিয়েছিলেন শ্রেয়স আইয়ার। দীনেশ কার্তিক নেতৃত্ব দিয়ে সফলতা না পাওয়ার পর শ্রেয়স আইয়ার-কে নেতৃত্বে চেয়েছিল নাইট কর্তৃপক্ষ। সেই সিদ্ধান্তটা তিন বছর পর কাজে দিল। গত বছর চোটের কারণে খেলতে পারেননি শ্রেয়স। এবার অধিনায়কত্বে ফিরেই একেবারে কাপ জিতলেন। তরুণদের সঙ্গে দারুণভাবে মিশে যেতে পারেন, তাড়াহুড়ো করে সিদ্ধান্ত নেন না, ঠান্ডা মাথার শ্রেয়সের গুণ হল দ্রুতসঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। এবারের আইপিএলে তাঁর বোলিং চেঞ্জগুলো দারুণ কাজে দিয়েছে।
৪) তারকা নয় দলগতি সংহতি:
মুম্বই, চেন্নাই কিংবা বেঙ্গালুরুর মত বড় তারকা নেই কলকাতা নাইট রাইডার্সে। নাইটদের স্কোয়াডে এমন কোনও ভারতীয় ক্রিকেটার নেই যারা আসন্ন টি২০ বিশ্বকাপে খেলবেন। এমনকী পেস কিংবা স্পিন বোলিংয়ে মিচেল স্টার্ক আর সুনীল নারিন বাদ দিলে, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বড় কোনও নামী বোলারও নেই। এরপরেও দলগতি সংহতি বা টিম স্পিরিটে ভর করে এল খেতাব।
৫) প্রতিশ্রুতিবান, তরুণ নাইট বিগ্রেড:
এবারের আইপিএলে নাইট রাইডর্সের নেপথ্য নায়করা হলেন- ১) ভেঙ্কটেশ আইয়ার, ২) বরুণ চক্রবর্তী, ৩) রমনদীপ সিং। ফাইনাল সহ গোটা টুর্নামেন্টে তিন নম্বরে দারুণ নির্ভরতা জুগিয়েছেন ভেঙ্কটেশ আইয়ার। বল হাতে বরুণ চক্রবর্তী এবার নাইটদের মধ্যে সবচেয়ে ধারাবাহিকতা দেখিয়েছেন। বরুণ শুধু মোক্ষম সময়ে উইকেটগুলোই নেননি, সঙ্গে বিপক্ষকে আটকে রেখে চাপ তৈরির কাজটা করেছেন। আর পিঞ্চ হিটার রমনদীপ সিং তো এবারের আইপিএলের আবিষ্কার। হর্ষিত রানা, অঙ্গকৃশ রঘুবংশীও বেশ নজর কেড়েছেন।
এক্স ফ্যাক্টার- মালিক শাহরুখ খান
আর অবশ্যই নাইট রাইডার্সের মালিক শাহরুখ খান। গ্যালারি তাঁর উপস্থিতি পুরো দলটাকে মানসিক দিক থেকে চাগিয়েছে। শাহরুখ বাক মালিকদের মত হেরে গেলে দলের ক্রিকেটারদের ওপর রেগে যান না। অধিনায়ক, কোচদের ক্রিকেটীয় জ্ঞান দেন না। জিততেই হবে না হলে চাকরি যাবে, তেমন মানসিক চাপও দেন না। জেতার মত হেরে গেলেও শাহরুখ সবার আগে এসে পিঠ চাপড়ে দলের ক্রিকেটারদের বলেন, হতাশ হও না, হার জিত থাকেই, আসল হল নিজের ওপর আত্মবিশ্বাস রাখা। নিজের ফল্প সিনেমার উদাহরণ দিয়েও তরুণ ক্রিকেটারদের বোঝান, দু একটা ম্যাচে খারাপ খেলা, ফর্মে না থাকাটা কোনও ফ্যাক্টার নয়, আসল হল নিজের লক্ষ্যে স্থির রাখা। এমন একজন মালিক, সফল মানুষ, ফারাক গড়ে দেন।