পার্থ প্রতিম চন্দ্র: কংগ্রেস ছেড়ে বেরিয়ে এসে একার ক্ষমতায় সরকার গড়া, তারপর টানা তিনটি বিধানসভায় অনায়াসে জয়। ভোটে সাফল্যের বিষয়ে এতটা সফল রাজনীতিবিদ ভারতের রাজনীতিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (Mamata Banerjee) একাই আছেন। সিপিএমের পর এখন বিজেপিকেও পরাস্ত করে চলেছেন মমতা। ১৯৯৮ সালের পয়লা জানুয়ারি নিজের দল গড়ার পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শুরুর দিকে তেমন সাফল্য পাচ্ছিলেন না।
২০০৪ লোকসভায় একমাত্র তিনি নিজে ছাড়া তার দলের সবাই হেরেছিলেন। তার দু বছর পর ২০০৬ বিধানসভা নির্বাচনে মাত্র ৩০টি আসনে জিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একেবারে হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলনের পর রাজ্যজুড়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তায় ভর করে ২০১১ সালে রাজ্যের মসনদে বসেন মমতা। আরও পড়ুন-সবচেয়ে ভাল থেকে খারাপ, বাংলায় কোন নির্বাচনে কেমন ফল করে তৃণমূল
তৃণমূলের ২৬ বছরের ইতিহাসে অনেক বড় সাফল্য, ব্যর্থতা, উচ্ছ্বাস, হতাশা এসেছে। কিন্তু তার মধ্যে সেরা ৬টি জয়কে বাছতে বললে যেগুলি আসবে---
১) ২০০০ পাঁশকুড়া লোকসভা উপনির্বাচনে জয়:
বাম গড় পাঁশকুড়ায় তখন এর আগে কখনও হারেনি সিপিআই। তৃণমূল তখন সবে বছর দুয়েকের দল। সেই অঞ্চলে সংগঠন বলতে কিছুই নেই। বুথে এজেন্ট দেওয়া তো দূরের কথা দলের পতাকা বইবার লোকেরও অভাব। সেই সময় এসে পড়ে উপনির্বাচন। সিপিআই প্রার্থী করে গুরুদাস দাশগুপ্ত-কে। সেখানে দিদি দাঁড় করান বিক্রম সরকার-কে। সব হিসেব উল্টে জিতে যান দিদির প্রার্থী বিক্রম সরকার। পাঁশকুড়া উপনির্বাচনে জয়টা নিজের দল করার পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাঠে সবচেয়ে স্মরণীয় আর তাতপর্যের। বামেদের যে হারানো যায় সেই বিশ্বাসটা পাঁশকুড়ায় পেয়েছিলেন তৃণমূল।
২) ১৯৯৯ লোকসভায় শ্রীরামপুর ও বারাসতে জয়:
মমতা বন্দ্য়োপাধ্যায় নিজের দল তৃণমূল কংগ্রেস তৈরির পর সেটাই ছিল তাঁর প্রথম নির্বাচন। কংগ্রেসের সঙ্গে অনেকটা তৈরি হওয়ায় বামেদের হারাতে বিজেপি-র সঙ্গে জোট গড়েছিলেন মমতা। সবাইকে চমকে তৃণমূল ৮টি আসনে জিতেছিল। সঙ্গে দিদির সঙ্গে জোট গড়ে বিজেপি প্রথমবার বাংলায় লোকসভা আসন জেতে। তৃণমূলের সংগঠন কাজে লাগিয়ে বিজেপি নেতা তপন সিকদার জিতেছিলেন বাম দুর্গ দমদমে।
১৯৯৯ লোকসভায় তৃণমূল যে আটটি আসনে জিতেছিল সেগুলি- কলকাতা দক্ষিণ (মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়), কলকাতা উত্তর পুর্ব (অজিত পাঁজা), কলকাতা উত্তর পশ্চিম (সুদীপ বন্দ্যোপাধ্য়ায়), যাদবপুর (কৃষ্ণা বসু), শ্রীরামপুর (আকবর আলি খন্দকর), কাঁথি (শিশির অধিকারী), বারাসত (রঞ্জিত পাঁজা) , নবদ্বীপ (আনন্দ মোহন বিশ্বাস)। এত কম সময়ে কার্যত বিনা সংগঠনে আটটি লোকসভা আসনে জিতে চমকে দিয়েছিলেন দিদি। এই আটটির মধ্যে মমতাকে সবচেয়ে তৃপ্তি দিয়েছিল শ্রীরামপুর ও বারসতে জয়। কারণ সেখানে দলের সংগঠন তৈরির সময়ই পাওয়া যায়নি।
৩) ২০১১ বিধানসভায় যাদবপুরে ততকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের বিরুদ্ধে জয়:
২০১১ বিধানসভায় ঐতিহাসিক জয়ের পর প্রথমবার বাংলায় ক্ষমতায় এসেছিলেন মমতা বন্দ্য়োপাধ্যায়। আর সেই নির্বাচনে তৃণমূল সমর্থকদের সবচেয়ে খুশি করেছিল যাদবপুর থেকে দাঁড়ানো ততকলানী মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য-র বিরুদ্ধে তৃণমূল প্রার্থী মণীশ গুপ্ত-র জয়। সবাইকে চমকে মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেবকে প্রায় ১৬ হাজার ভোটে হারিয়েছিলেন মমতার সৈনিক মণীশ।
৪) ২০০৯ লোকসভায় নন্দীগ্রাম, সিঙ্গুর সহ কংগ্রেসের সঙ্গে জোট গড়ে ২৬টি আসনে জয়:
বাংলায় যে বামেদের সরিয়ে মমতা ক্ষমতায় আসবেন সেটার প্রথম স্পষ্ট বড় বার্তা দিয়েছিল ২০০৯ লোকসভা নির্বাচন। তখনও রাজ্যজুড়ে বামেদের সংগঠন দারুণ মজবুত। অন্যদিকে, সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম আন্দোলনে করে মমতা তখন দেশজুড়ে আলোচিত নাম। বাংলার সংবাদমাধ্যমে তখনও বামেদের দিকে হাওয়া ছিল। বঙ্গ রাজনীতিতে তখন কী হয় কী হয় টেনশনের মাঝে ২০০৯ লোকসভায় মমতা জোট গড়লেন কংগ্রেস ও এসইউসিআইয়ের সঙ্গে। বামেদের ভোটব্যাঙ্কে ধস নামিয়ে সেই ভোটে মমতার নেতৃত্বে সেই সময় রাজ্যের বিরোধী জোট জিতল ২৬টি আসন আর বামেরা সেখানে পেল মাত্র ১৫টি আসন, গোর্খা সমর্থনে বিজেপি জেতে দার্জিলিংয়ে।
যেখানে ২০০৪ লোকসভায় তৃণমূল মাত্র ১টি আসনে জিতে অস্তিত্বসঙ্কটে ভুগছিল। ২০০৯ লোকসভায় তৃণমূল একাই জেতে ১৯টি-তে, কংগ্রেস ৬টি, আর এসইউসিআই পায় মথুরাপুর আসনটি। সেখানে সিপিএম মাত্র ৯টি আসনে জেতে। এই ভোটেই পরিষ্কার হয়ে যায় দিদির বাংলার মসনদে বসা সময়ের অপেক্ষা। ২০০৯ লোকসভায় ১৯টি আসনের মধ্যে তৃণমূলের কাছে সবচেয়ে তৃপ্তির জয় ছিল- নন্দীগ্রামের তমলুক, আর সিঙ্গুরের হুগলি লোকসভায় জয়টা। তমলুকে দোর্দণ্ডপ্রতাপ লক্ষ্মণ শেঠকে হারিয়েছিলেন সেই সময় তৃণমূলের লড়াকু তরুণ নেতা শুভেন্দু অধিকারী, আর হুগলিতে অপরাজেয় তথা ৬ বারের সাংসদ রুপচাঁদ পাল-কে হারান রত্না দে নাগ।
৫) ২০১৪ লোকসভায় ৮৩ শতাংশ আসনে জয়:
২০১৪ লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল বাংলায় ৩৫টি আসনে জেতে। তার মধ্যে আসানসোল ছাড়া দক্ষিণবঙ্গের সব কটি আসনে জেতে তৃণমূল। দার্জিলিং, মুর্শিদাবাদ, মালদা জেলা ছাড়া গোটা বাংলা দিদির দুর্গে পরিণত হয়।
৬) ২০২১ বিধানসভায় তারকা প্রার্থী, দলত্যাগীদের বিরুদ্ধে জয়
২০২১ বিধানসভা ভোটে তৃণমূলের একের পর নেতা-মন্ত্রী-বিধায়করা তৃণমূল ছেড়েছিলেন। তখন রাজ্যের মন্ত্রী থাকা রাজীব বন্দোপাধ্যায় থেকে হবালির সেই সময়ের বিধায়ক বৈশালী ডালমিয়া দল ছেড়ে বিজেপিতে নাম লিখিয়েছিলেন। কিন্তু ২০২১ বিধানসভায় শুভেন্দু অধিকারী ছাড়া প্রায় সবাই হারেন। হেরে যান সাংসদ থেকেও বিধানসভায় লড়া লকেট চট্টোপাধ্যায়, বাবুল সুপ্রিয়-রাও।