মোহনবাগান ক্লাব ও সেই ১১ বাঙালির ভাস্কর্য (Photo Credits: Social Media)

ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে মোহনবাগানের (Mohun Bagan) এক অবিচ্ছেদ্য যোগাযোগ রয়েছে। ঘটি বাঙালের তরজার অনেক আগেই বাঙালির সংঘবদ্ধভাবে ব্রিটিশদের পায়ের তলাতেই হারাতে চেয়েছিল। যে জয় এসেছিল ১৯১১ সালে। সুসজ্জিত ১১ জোড়া বুটকে কাত করার জন্য সেদিন ১১ জন বাঙালির খালি পা যথেষ্ট ছিল।  প্রথমবার ভারতীয় কোনো দল জিতলো আইএফএ শিল্ড। খেলোয়াড়দের মাথায় তুলে চলল ৮০ হাজার দর্শকের উল্লাসনৃত্য। জয়োল্লাসের মিছিলে তখন জাতীয়তাবাদী স্লোগান ছিল আনন্দ প্রকাসের অন্যতম মাধ্যম। একটি দল হয়ে উঠল গোটা একটি দেশ। ১০৯ বছর আগের ইতিহাসের এই শিহরণের নাম মোহনবাগান। কলোনিয়াল শাসনের নাগপাশ থেকে মুক্তি পেতে বাঙালিদের অবদান অনস্বীকার্য।

তখন সরাসরি যুদ্ধে ব্রিটিশ রাজের শক্তি খর্ব করা অসম্ভব থাকলেও গোরাদের শেখানো খেলায় গোরাদেরকেই হারিয়ে দেওয়া তো পরাধীন জাতির কাছে স্বাধীনতার আন্দোলনের স্বাদ এনে দেয়। কিন্তু মাস্টারদা সূর্য সেন, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারদের থেকে কোনও অংশে কম স্বাধীনতা সংগ্রামী নন সেদিনে সেই ১১ জন বাঙালি  শিবদাস ভাদুড়ি, অভিলাষ ঘোষ, কানু রায়রা। ইংরেজদের দর্প চূর্ণ করে অবিভক্ত ভারতকে তারা দিয়েছিলেন অপরিসীম আত্মবিশ্বাস, বিজয়ের প্রাথমিক স্বাদ। কারা ছিলেন এরা? দলের গণ্ডি পেরিয়ে গোটা দেশের অনুপ্রেরণার নামই বা কীভাবে হয়েছিলো মোহনবাগান? আজও ফুটবলে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল লড়াই মানেই যেন ঘটি-বাঙালের চিরায়ত দ্বৈরথ, যার আঁচে আন্দোলিত হয় গোটা পশ্চিমবঙ্গ। সেই মোহনবাগান ক্লাবটি কিন্তু রিয়াল মাদ্রিদ কিংবা বার্সেলোনার থেকেও বয়সে বড়। আরও পড়ুন-Mysuru Barber Family: তপশিলি জাতি উপজাতিদের চুল কাটায় অপরাধ, নাপিত পরিবারকে একঘরে করল গ্রাম প্রধান

উত্তর কলকাতার ফড়িয়া পুকুরের বাসিন্দা মিত্র, সেন ও বসু পরিবারের উদ্যোগে তৈরি হয় এই মোহনবাগান ফুটল ক্লাব। কিরীটি মিত্রর বাড়ি মোহনবাগান ভিলাতেই এই ক্লাবের প্রতিষ্ঠা হয় নাম হয়েছিল মোহনবাগান স্পোর্টস ক্লাব। সেই সময় বসু পরিবারের পুত্র তথা কলকাতার বিশিষ্ট আইনজীবী ছিলেন ভূপেন্দ্র নাথ বসু। তিনিই হন এই ক্লাবের সভাপতি। পরে নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় মোহনবাগান অ্যাথলেটিক ক্লাব। ১৯১১ সালের জুলাই মাস। বঙ্গভঙ্গ ও ক্ষুদিরামের ফাঁসি নিয়ে ফুঁসছে তখন দুই বাংলার জাতীয়তাবাদী জনতা। প্রতিবাদের আগুন নেভাতে দমননীতি বেছে নিয়েছিলো ব্রিটিশ সরকার। তখনই আশার একমাত্র অবলম্বন হিসেবে হাজির হয় মোহনবাগান। ভারতবর্ষের সবথেকে সম্মানজনক ফুটবল টুর্নামেন্ট আইএফএ শিল্ডের সেমিফাইনালে তারা হারিয়ে দেয় ইংরেজ ক্লাব মিডলসেক্সকে। ফাইনালে প্রতিপক্ষ হিসেবে ছিলো আরেক ইংরেজ ক্লাব ইস্ট ইয়র্কশায়ার রেজিমেন্ট। পরাধীন ভারতে এই প্রথম কোনও দেশীয় ক্লাব জিতল আইএফএ শিল্ড। এরপর ভারতের কোণে কোণে রোমাঞ্চের প্রতিশব্দ হয়ে গেল মোহনবাগান।

ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ১১ জন বাঙালির সেই খালি পায়ে জয়ের নিশান ওড়ানো শুধু অবিভক্ত বঙ্গদেশ নয়, গোটা ভারতের কাছেই স্বাধীনতার প্রাথমিক স্বাদ এনে দিয়েছিল। আর বাঙাল ঘটির প্রসঙ্গ এখানে অর্থহীন কারণ মোহনবাগানের সেই ১১ বাঙালির মধ্যে ঢাকার ভাদুড়ি পরিবারেরই সন্তান ছিলেন মোহনবাগানের অধিনায়ক শিবদাস ভাদুড়ি ও অন্যতম খেলোয়াড় বিজয়দাস ভাদুড়ি। আর ‘১১ এর শিল্ডজয়ী কানু রায় ও রাজেশ সেনগুপ্ত খেলোয়াড় জীবনের শুরুতে পূর্ব বাংলাতেই। এমনকি শিল্ডজয়ী দলের অধিকাংশই ছিলেন ‘বাঙাল’ বা পূর্ববঙ্গের আদি বাসিন্দা। শোনা যায়, শিল্ড ফাইনাল শেষে বিজয় মিছিল যখন ফোর্ট উইলিয়ামের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় কেউ অধিনায়ক শিবদাসকে জিজ্ঞেস করেছিলেনন, “ব্রিটিশরা কবে যাবে?” অধিনায়কের উত্তর ছিল, “যেবার আমরা ফের শিল্ড জিতব।” কাকতালীয়ভাবে মোহনবাগানের দ্বিতীয় শিল্ড ঘরে এসেছিল ১৯৪৭ সালেই! তাই মোহনবাগান শুধু একটি দল নয়, আবেগেরও নাম। ১৯৮৯ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী মোহনবাগানকে জাতীয় ক্লাব হিসেবে আখ্যায়িত করেন।