সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (Photo: Twitter)

কলকাতা, ৮ এপ্রিল: আজ সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের (Bankim Chandra Chattopadhyay) মৃত্যুদিন। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে প্রথম আধুনিক বাংলা ঔপন্যাসিক হিসেবে গণ্য করা হয়। প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক হিসেবেও পরিচিত ছিলেন তিনি। ভারতের জাতীয় সংগীত 'বন্দে মাতরম'-র (Vande Mataram) লেখক ১৮৯৪ সালের আজকের দিনেই তিনি প্রয়াত হন। কিন্তু তাঁর কাজ আজও ভরতীয় রাজনীতিতে, সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে রেখেছে। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ১৮৩৮ সালের ২৭ জুন উত্তর ২৪ পরগনা জেলার নৈহাটি শহরের কাছাকাছি কাঁঠালপাড়ায় জম্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম যাদবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তাদের আদি নিবাস ছিল হুগলি জেলার দেশমুখো গ্রামে। যাদবচন্দ্র ছিলেন সরকারি চাকরিজীবী। শৈশব থেকেই বঙ্কিমচন্দ্রের প্রতিভার বিষয়টি লক্ষ্য করা যায়। ১৮৮২ সালে রচিত আনন্দমঠ উপন্যাসের অন্তর্ভুক্ত একটি গান হল বন্দে মাতরম। সংস্কৃত-বাংলা মিশ্রভাষায় লিখিত এই গান ভারত মাতা বন্দনাগীতি এবং বাংলা মা তথা বঙ্গদেশের একটি জাতীয় মূর্তিকল্প। শ্রীঅরবিন্দ বন্দে মাতরম গানটিকে "বঙ্গদেশের জাতীয় সংগীত" (National Anthem of Bengal) বলে উল্লেখ করেন। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে এই গানটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল।

১৮৯৬ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে সর্বপ্রথম রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে গাওয়া হয় বন্দে মাতরম গানটি। উক্ত অধিবেশনে গানটি পরিবেশন করেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ১৯৫০ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে ভারতের জাতীয় স্তোত্র-র মর্যাদা লাভ করলে বন্দে মাতরম্ গানটিকে জাতীয় সংগীতের মর্যাদা দেওয়া হয়। ১৯০৯ সালে শ্রী অরবিন্দ Mother, I bow to thee! শিরোনামে বন্দে মাতরম্ গানটির ইংরেজি অনুবাদ করেন। ইংরেজি ভাষায় এই অনুবাদটি বহুল প্রচলিত। একাধিকবার এই গানটিতে সুরারোপ করা হয়। বন্দে মাতরম্ প্রাচীনতম প্রাপ্ত অডিও রেকর্ডিংটি ১৯০৭ সালের। সমগ্র বিংশ শতাব্দীতে গানটি প্রায় একশোটি ভিন্ন সুরে রেকর্ড করা হয়েছিল। ২০০২ সালে বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ দশটি জনপ্রিয় গান নির্বাচনের একটি আন্তর্জাতিক সমীক্ষা চালায়। এই সমীক্ষায় ৭০০০ গানের মধ্যে থেকে এ আর রহমান সুরারোপিত বন্দে মাতরম্ গানটি বিশ্বের দ্বিতীয় জনপ্রিয়তম গান নির্বাচিত হয়। আরও পড়ুন: Shab-E-Barat 2020 Wishes in Bengali: শবে বরাত উৎসবের দিনে আপনার আত্মীয়স্বজন, পরিবার, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে শেয়ার করে নিন

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় অল্প বয়সেই লেখালেখি শুরু করেন। ১৫ বছর বয়সে তিনি দুটি ছোট কবিতা লিখেন। আর হুগলি কলেজে পড়ার সময় তিনি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের রচনার আদর্শে ‘সংবাদ প্রভাকর’ও ‘সংবাদ সাধুরঞ্জন’-এ গদ্য, পদ্য লিখতেন। ১৮৫৩ সালে ‘সংবাদ প্রভাকর’ এ কবিতা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন তিনি। প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে ২০ টাকা পুরস্কার পান। সমগ্র জীবনে বঙ্কিমচন্দ্র ৪২ বছরের সাহিত্যসাধনা করেন। কমলাকান্ত ছদ্মনামেও লেখালেখি করেন তিনি। ছাত্রজীবন থেকে শুরু করে শেষজীবন পর্যন্ত ব্যাপ্ত ছিল এই ৪২ বছর। ১৮৯৪ সালের মার্চ মাসে তিনি শেষ লেখা লেখেন। তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ৩৪টি। ভালো আবৃত্তিকারও ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র। তবে লেখক ও হিন্দু পুনর্জাগরণের দার্শনিক হিসেবেই তিনি বেশি বিখ্যাত। তিনি বিখ্যাত বঙ্গদর্শন (১৮৭২-১৮৭৬) পত্রিকা সম্পাদনা ও প্রকাশ করেন। এর মাধ্যমে একটি নতুন লেখকগোষ্ঠীর আবির্ভাব ঘটে। তার লেখনিতে প্রাচীন ভারতের নৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় ঐতিহ্যের পুনঃপ্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা ফুটে ওঠে। ইংরেজি ভাষায় বিশেষ দক্ষ ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র। চাকরি জীবনে খুলনায় পোস্টিংয়ের সময় তিনি ‘Rajmohan’s Wife’ নামে একটি ইংরেজি উপন্যাসও লিখেছেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ‘দুর্গেশনন্দিনী’ উপন্যাস দিয়েই তার সাহিত্য জীবনের আরম্ভ। এই উপন্যাস দিয়েই বঙ্কিমচন্দ্র আধুনিক বাংলা সাহিত্যে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেন। বাঙালির রোমান্টিক সত্তার এক নতুন জাগরণ ঘটে তার উপন্যাসে। তার তিনটি উপন্যাস ‘দুর্গেশনন্দিনী’, ‘কপালকুণ্ডলা’ ও ‘মৃনালিনী’ তারই উকৃষ্ট প্রমাণ। পরে বঙ্গদর্শন পত্রিকার প্রকাশনা ও সম্পাদনার মাধ্যমে তার নতুন পরিচয় ও মেথার স্বাক্ষর পাওয়া যায়। এই মাসিক পত্রিকায় তিনি পরপর ‘বিষবৃক্ষ’, ‘ইন্দিরা’, ‘যুগলাঙ্গুরীয়’, ‘চন্দ্রশেখর’ ইত্যাদি উপন্যাসের সঙ্গে নানা বিষয়ে নানা প্রবন্ধ লিখতে থাকেন। বঙ্গদর্শনের আবির্ভাব বাংলা সাহিত্যে নতুন যুগের সূচনা করেছিল। পত্রিকাটির সম্পাদক হিসেবে বঙ্কিমচন্দ্রের অবদান হলো প্রবন্ধ ও সমালোচনা সাহিত্যের বিকাশ ও বিস্তার। দুবছর বন্ধ থাকার পর তাঁর ভাই সঞ্জীবচন্দ্রের সম্পাদনায় ‘বঙ্গদর্শন’ আবার বের হয়। ‘রাধারাণী’, ‘রজনী’, ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’এ সময়ের লেখা।

বঙ্কিমচন্দ্রের প্রায় সব উপন্যাসই ইংরেজি, জার্মান, হিন্দি, কানাড়া, তেলেগু প্রভৃতি ভাষায় অনুবাদ হয়েছে। তার উপন্যাসগুলির নাট্যরূপ হয়েছে মঞ্চে, হয়েছে চলচ্চিত্র। ভাষা ও উপন্যাসের কাঠামো তৈরির বিষয়ে তিনি ছিলেন পথপদর্শক। রাষ্ট্রীয়, ধর্মীয়, সামাজিক ও শিক্ষামূলক উন্নতির সব রকম প্রয়াসে অবিরাম লেখে গেছেন তিনি। ঐতিহাসিক, রোমান্টিক, পারিবারিক- এই তিন ধারায় উতসারিত বঙ্কিমচন্দ্রের অ্যাখ্যানগুলি সমসাময়িক ও পরবর্তী সাহিত্য ও জীবনের ওপর অপরিসীম প্রভাব বিস্তার করেছে। তাঁর লেখা প্রবন্ধগুলো হলো কমলাকান্তের দপ্তর, লোকরহস্য, কৃষ্ণচরিত্র, বিজ্ঞানরহস্য, বিবিধ সমালোচনা, প্রবন্ধ-পুস্তক, সাম্য ও বিবিধ প্রবন্ধ (১ম খণ্ড : ১৮৮৭, ২য় খণ্ড : ১৮৯২)। এছাড়া তাঁর অন্যান্য কাজগুলি হলো ললিতা, ধর্ম্মতত্ত্ব অনুশীলন, সহজ রচনা শিক্ষা, শ্রীমদ্ভগবদগীতা ও কবিতাপুস্তক। সম্পাদনা করেছেন দীনবন্ধু মিত্রের জীবনী, বাংলা সাহিত্যে প্যারীচাঁদ মিত্রের স্থান ও সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জীবনী। শেষ জীবনে তার স্বাস্থ্য তেমন ভালো ছিল না। ১৮৯৪ সালের মার্চ মাসে তার বহুমূত্র রোগ বেশ বেড়ে যায়। এই রোগেই অবশেষে ওই বছরের ৮ এপ্রিল মারা যান তিনি।