পার্থ প্রতিম চন্দ্র: বিহার বিধানসভা নির্বাচনে (Bihar Assembly Elections 2025) নির্ঘণ্ট প্রকাশ করেছে নির্বাচন কমিশন। আগামী ৬ ও ১১ নভেম্বর বিহারে দু দফায় বিধানসভা নির্বাচনে ভোটগ্রহণ হবে। ফলপ্রকাশ ১৪ নভেম্বর। গত বছর লোকসভা নির্বাচনের পর দেশের রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হতে চলে বিহারের ভোট। কারণ তৃতীয়বার নরেন্দ্র মোদী সরকারের গঠনের পিছনে বড় ভূমিকা আছে নীতীশ কুমারের। বিজেপি একক সংখ্য়াগরিষ্ঠতা থেকে দূরে থাকায়, মূলত নীতীশ কুমার ও এন চন্দ্রবাবু নাইডুর সমর্থনে কেন্দ্রে সরকার গড়েছেন নরেন্দ্র মোদী। যে নীতীশ কুমার একটা সময় কংগ্রেস ও আরজেডির সমর্থনে মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন। দেশে বিরোধীদের ইন্ডিয়া জোট গঠনের পিছনেও সবচেয়ে বড় ভূমিকাটা ছিল নীতীশের। তাই বিহারে বিজেপি হেরে গেলে কেন্দ্র মোদী সরকারের ওপর বড় প্রভাব পড়তে পারে বলে মনে করছে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞমহল। আবার মহারাষ্ট্রের মত বিহারে সসম্মানে পাশ করে গেলে ফের সমহিমায় দেখা যেতে পারে প্রধানমন্ত্রী মোদীকে। তাই বিহারের ভোটের দিকে তাকিয়ে গোটা দেশ।
কিং হওয়ার দ্বৈরথে নীতীশ বনাম তেজস্বী, কিংমেকার হওয়ার লড়াইয়ে চিরাগ পাসোয়ান, প্রশান্ত কিশোররা
বিহারে মূল লড়াই মোদী-নীতীশের এনডিএ বনাম রাহুল গান্ধী-তেজস্বী যাদবের মহাগঠবন্ধন বা ইন্ডিয়া। তৃতীয় পক্ষ হিসাবে হাজির ভোটগুরু প্রশান্ত কিশোরও। মুখ্যমন্ত্রী পদে সরাসরি লড়াইয়ে নীতীশ ও লালুপুত্র তেজস্বী। গত বছর লোকসভা ভোটে বিহারে ভাল ফল করেছিল বাম দলগুলি। বিহারে এবার বিজেপিকে হারাতে বেশ কিছু জায়গায় লড়ছে বাম দলগুলি। তবে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী চিরাগ পাসোয়ান, হাম নেতা জিতিন রাম মাঝি-র মত ছোট দলগুলিও কিং মেকার হয়ে উঠতে পারে। চিরাগ আবার সরাসরি ভোটে লড়ছেন মুখ্যমন্ত্রীর গদির দিকে চোখ রেখে। এক নজরে বিহার ভোটের নির্ঘণ্ট
SIR নিয়ে বিস্ফোরক অবিযোগ বিরোধীদের
বিহারে ভোটের মুখে নির্বাচন কমিশনের নিবিড় সমীক্ষা বা SIR ও বিশেষ নিবিড় ভোটার তালিকা সংশোধন নিয়ে বিরোধী দলগুলি বারবার বিস্ফোরক অভিযোগ জানিয়েছে। বিহারে ভোটার তালিকার বিশেষ নিবিড় সংশোধন (SIR) প্রক্রিয়া শেষে গত ৩০ সেপ্টেম্বর চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ করেছিল কমিশন। ২২ বছর পর বিহারে SIR হলো। নিবিড় সমীক্ষার খসড়া থেকে বাদ পড়েছিল ৬৫ লক্ষ ভোটারের নাম। কমিশন সূত্রে খবর, চূড়ান্ত তালিকায় রয়েছে ৭.৪ কোটি ভোটার। বাদ পড়েছে প্রায় ৪৮ লাখ ভোটারের নাম। যেখান জুনে বিহারের ভোটার তালিকায় মোট ৭.৮৯ কোটি ভোটারের নাম ছিল। আরও পড়ুন- দেশের যে আটটি বিধানসভা আসনে হচ্ছে উপনির্বাচন
এক নজরে দেখে নেওয়া যাক বিহার নির্বাচন নিয়ে আটটি তথ্য--
১) বিহারে মোট কটি বিধানসভা আসন আছে:
বিহারে মোট ২৪৩টি বিধানসভা আসন আছে। সরকার গড়তে হলে অন্তত সরকার গড়ার জন্য প্রয়োজন হয় ১২২ জন বিধায়কের।
২) ভোটগ্রহণ, ফলপ্রকাশ কবে:
আগামী ৬ ও ১১ নভেম্বর ভোটগ্রহণ হবে। প্রথম দফায় মোট ১২১টি আসনে ভোটগ্রহণ হবে। দ্বিতীয় তথা শেষ দফায় হবে বাকি ১২২টি আসনে। ফলপ্রকাশ ১৪ নভেম্বর।
৩) মুখ্যমন্ত্রীর লড়াইয়ে কারা:
এনডিএ পদের মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী নীতীশ কুমার। বিরোধীদের মহাগঠবন্ধন বা ইন্ডিয়া জোটের মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী আরজেডি-র শীর্ষ নেতা তেজস্বী যাদব। তবে শেষ পর্যন্ত বিজেপি একাই সরকার গড়ার মত জায়গায় চলে গেলে পদ্মশিবিরের নেতা তথা বর্তমান উপমুখ্যমন্ত্রী সম্রাট চৌধুরীও মুখ্যমন্ত্রী হতে পারেন। এনডিএ-র দল আরএলজিপি (রামবিলাস)-এর নেতা তথা কেন্দ্রীয় চিরাগ পাসোয়ানও নিজেকে মুখ্যমন্ত্রীর পদে লড়াইয়ে দেখছেন। তবে চিরাগের পক্ষে খুব কম সংখ্যক আসনে দাঁড়িয়ে মসনদে বসা কঠিন। প্রশান্ত কিশোরও তৃতীয় শক্তির মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী রয়েছেন। তবে এবারের ভোটে তাঁর পক্ষে কিং নয়, বড়জোড় কিংমেকার হওয়া সম্ভব।
৪) হেভিওয়েট প্রার্থীরা:
কোন দল এখন প্রার্থী ঘোষণা করেনি। তবে বিহারে হেভিওয়েট প্রার্থীর ছড়াছড়ি। মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার, বিরোধী দলনেতা তেজস্বী যাদব, উপমুখ্যমন্ত্রী সম্রাট চৌধুরী, এলজেপি (রামবিলাস) নেতা তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী চিরাগ পাসোয়ান, প্রশান্ত কিশোর সরাসরি ভোটে দাঁড়াচ্ছেন। বিজেপি এবার বেশ কয়েকজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও সাংসদকেও ভোটে দাঁড় করাতে পারে বলে খবর। অন্যদিকে, তেজস্বী যাদবের পাশাপাশি লালুর পরিবারের আরও তিন-চারজন সদস্য বিধানসভা ভোটে লড়তে পারেন বলে খবর। তেজস্বীর দাদা তেজপ্রতাপ যাদবকে শৃঙ্খলাজনিত কারণে দল থেকে বহিষ্কার করে দেন আরজেডি প্রধান লালু। তেজপ্রতাপ এবার নির্দল প্রার্থী হয়ে ভোটে দাঁড়াচ্ছেন। নীতীশ এবার কোন আসন থেকে লড়বেন তা স্পষ্ট নয়। আরজেডি নেতা তথা বিরোধী জোটের মুখ তেজস্বী যাদব লড়বেন বৈশালী জেলার হাজিপুরের রাঘোপুর বিধানসভা থেকে। এই আসনে দুবার লালুপ্রসাদ ও তিনবার তাঁর স্ত্রী রাবড়ি দেবী ভোটে জিতেছিলেন।
৫) কারা এগিয়ে:
গত বছর লোকসভায় বিজেপির নেতৃত্বে লড়া এনডিএ-কে ঢেলে ভোট দিয়েছিল বিহারবাসী। কিন্তু গতবার দেখা গিয়েছে, বিধানসভার ক্ষেত্রে লোকসভা ভোটের বছরখানেকের মধ্যে হওয়া বিহার বিধানসভা নির্বাচনে লালুর দল তেজস্বীকে মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে বেশি মনে ধরেছে রাজ্যবাসীর। ভোটের আগে বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, বিহারে এনডিএ এগিয়ে আছে ঠিকই কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসাবে নীতীশের থেকে তেজস্বীর জনপ্রিয়তা বেশি। কম বয়সী ভোটারদের মধ্যে তেজস্বীকে নিয়ে বেশি আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। তবে এখনও ভোটের মাসখানেক বাকি। এর মধ্য়ে প্রচার পর্বে কে কতটা ঝড় তুলতে পারে সেটা দেখার।
৬) ভোটার তালিকা নিয়ে:
বিহারে ভোটের মুখে নির্বাচন কমিশনের নিবিড় সমীক্ষা বা SIR ও বিশেষ নিবিড় ভোটার তালিকা সংশোধন নিয়ে বিরোধী দলগুলি বারবার বিস্ফোরক অভিযোগ জানিয়েছে। বিহারে ভোটার তালিকার বিশেষ নিবিড় সংশোধন (SIR) প্রক্রিয়া শেষে গত ৩০ সেপ্টেম্বর চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ করেছিল কমিশন। ২২ বছর পর বিহারে SIR হলো। নিবিড় সমীক্ষার খসড়া থেকে বাদ পড়েছিল ৬৫ লক্ষ ভোটারের নাম। কমিশন সূত্রে খবর, চূড়ান্ত তালিকায় রয়েছে ৭.৪ কোটি ভোটার। বাদ পড়েছে প্রায় ৪৮ লাখ ভোটারের নাম। যেখান জুনে বিহারের ভোটার তালিকায় মোট ৭.৮৯ কোটি ভোটারের নাম ছিল।
৭) বিহার রাজনীতির গতিপ্রকৃতি:
বিহারে বহুযুদ্ধের ঘোড়া নীতীশ কুমার এবারও সবার নজরে। ৭৪ বছরের নীতীশ এবারই হয়তো শেষবার ভোটে লড়ছেন। বারবার শিবির বদল করা নীতীশ কথা দিয়েছেন, তিনি আর কখনও বিজেপির হাত ছাড়বেন না। বিহারের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বেও নীতীশকে খুব গুরুত্ব দিচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও নীতীশের ওপরই ভরসা রাখছেন। বিরোধী দলনেতা তেজস্বী য়াদব কিন্তু নীতীশকে নিয়ে খুব একটা আক্রমণ করছেন না। তেজস্বী-রাহুল গান্ধীদের যাবতীয় তোপ বিজেপিকে নিয়ে। রাজনৈতিক মহল বলছে, নীতীশের জন্য দরজা হাট করে খুলে রাখছে বিরোধীরা। বিজেপি সেটা বুঝতে পারলেও কিছুই করতে পারবে না। ২৪৩টি আসনের বিধানসভায় নীতীশের দলকে এবারও ১১০-১১৫টি আসনে ছাড়তেই হবে বিজেপিকে। সঙ্গে আবার চিরাগ পাসোয়ান, উপেন্দ্র কুশহওয়া, জিতিন রাম মাঝিদের মত শরিক দলগুলিকেও আসন ছাড়তেই হবে। তাই বিজেপির পক্ষে লড়ার মত খুব বেশি আসন থাকছে না। তবু নীতীশকে কোনও মতেই চটাতে রাজি নন মোদী-শাহ। অনেকেই মনে করছেন, মহারাষ্ট্রে একনাথ শিন্ডের মত মডেলে নীতীশ কুমারকে ট্রিট করতে পারে বিজেপি, যদি মারাঠা প্রদেশের মত অভাবনীয় কিছু ফল হয়। বিরোধী শিবিরে তেজস্বীই একাই ১০০। কংগ্রেসের শক্তি কম। খুব বেশি আসন কংগ্রেসকে নাও ছাড়তে পারে আরজেডি। গতবার কংগ্রেসের ভরাডুবির কারণে তেজস্বীর মুখ্যমন্ত্রী হওয়া হয়নি। তবে রাহুল গান্ধী মাঠে নামায় গতবারের চেয়ে কংগ্রেসকে এবার তুলনায় শক্তিশালী দেখাচ্ছে।
৮) প্রশান্ত কিশোর ফ্যাক্টর কতটা
প্রশান্ত কিশোর নিজেকে অনেকটা দিল্লির অরবিন্দ কেজরিওয়ালের মত স্টাইলে ভোটের ময়দানে দাঁড় করিয়েছেন। গত বছর গান্ধী জয়ন্তীতে নিজের দল জন সুরাজ পার্টি খোলেন প্রশান্ত। এরপর বিহারের গ্রামেতগঞ্জে চষে বেরাচ্ছেন। ভোটপ্রচারের অনেক আগে থেকেই রাজ্যের সব প্রান্তে ঘুরেছেন ভোটগুরু। প্রশান্ত বিজেপি, জেডিইউ, কংগ্রেস, আরজেডি-র সঙ্গে সমদূরত্ব রেখে ভোটে লড়ছেন। তাঁর মূল স্লোগান দুর্নীতিমুক্ত স্বচ্ছ বিহার যেখানে সব বেকাররা কাজ পাবে, বিহারীদের আর বিহারের বাইরে কাজ খুঁজতে যেতে হবে না। তবে কিছু জেলায় কিছু আসনে ছাড়া প্রশান্তের নতুন দলের পক্ষে ছাপ ফেলা কঠিন। এখনও বিহার রাজনীতিতে নীতীশ বনাম লালু (এখন তেজস্বী)-র মধ্যেই সীমাবদ্ধ।