একজন ত্রুটিহীন মানুষ হতে চেয়েছিলেন পরিচালক সত্যজিৎ রায়। নিজের ছবিতে নিজেই ভুল ধরে আবার তার বইও প্রকাশ করেছিলেন তিনি। গোটা পৃথিবীর গ্রাম বাংলার সঙ্গে পরিচয় হয় তাঁর হাত ধরেই। তাঁর অন্যতম সৃষ্টি 'পথের পাঁচালি' চলচ্চিত্রে ফুটিয়ে তুলেছিলেন আমাদের গ্রাম বাংলাকে। বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের কাহিনীর ওপর ভিত্তি করে ছবির মাধ্যমে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছিলেন পারিবারিক দারিদ্রতা, অবহেলা। প্রকৃতির সৌন্দর্য, সামাজিক জ্বালা-যন্ত্রনা, মৃত্যু, সম্পর্কের মজবুত বাঁধন তাও রয়েছে ছবির পরতে পরতে। সাদা কালো গ্রাম বাংলা অস্কার কমিটিকেও মুগ্ধ করেছিল। তবে জীবনের শেষ সময়ে তাঁর হাতে অস্কার এসে পৌঁছয়। নিজ বাসস্থানে বিছানায় শুয়ে অস্কার কমিটিকে ধন্যবাদ জানানোর বক্তৃতা আজও বাঙালি সোশ্যাল মিডিয়ায় উদ্যম হয়ে খোঁজে। বাঙালির রবি প্রেমের পর সত্যজিত প্রেম চিরকালীন ও গভীর।
আজ জন্মশতবর্ষের লগ্নে দাঁড়িয়ে পরিচালক সত্যজিৎ রায়। একের পর এক কালজয়ী ছবি উপহার দিয়ে বাংলা চলচ্চিত্র ভান্ডারকে পরিপূর্ণ করে গেছেন। প্রতিটি ছবিকে মণি-মুক্তোর মত আগলে রেখেছে বাঙালি তথা দেশবাসী। আজও দেশ-বিদেশের তাবড় তাবড় পরিচালকদের হাতেখড়ি হয় তাঁর চলচ্চিত্র দিয়ে। বিশ্ববরেণ্য পরিচালকের চিত্রনাট্যে শব্দের থেকে স্কেচের আধিক্য বেশি। বাস্তব জীবনের কল্পনাকে রূপোলি পর্দায় কবিতার আকারে ফুটিয়ে তুলতে সিদ্ধহস্ত ছিলেন তিনি। আরও পড়ুন, ‘জীবনটা সিনেমা নয়, এর রিটেক হয় না’, ইরফানকে নিয়ে সুতপার কথা
'পথের পাঁচালি' ছাড়া তাঁর তৈরি চলচ্চিত্রগুলির মধ্যে কিছু কালজয়ী সিনেমা- জলসাঘর, মহানগর, চারুলতা, নায়ক, গুপী গাইন বাঘা বাইন, অরণ্যের দিনরাত্রি, সোনার কেল্লা, শতরঞ্জ কি খিলাড়ি, জয় বাবা ফেলুনাথ, হীরক রাজার দেশে, কাপুরুষ মহাপুরুষ, পরশ পাথর ইত্যদি। চারুলতার মধ্যে দিয়ে দেখিয়েছিলেন অভিজাত পরিবারের একাকিনী চারুকে। গুপী গাইন বাঘা বাইনের 'ভুতের রাজার বর' বাচ্চা থেকে বুড়ো সকলকে কল্পনা থেকে বিশ্বাসের জায়গায় পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন এই মানুষটি। জীবনে একবার হাততালি দিয়ে মন্ডা-মিঠাই চাওয়ার ইচ্ছেপ্রকাশ করেনি, এমন বাঙালি কমই আছে। যতবার এসেছেন ততবার নতুন করে ভাবিয়েছেন। তাঁর ভাবনা আজও প্রাসঙ্গিক। দেশপ্রধানের চাপিয়ে দেওয়া আইন-কানুনে বাঙালির ট্যাগলাইন হয়ে দাঁড়িয়েছে-' দড়ি ধরে মারো টান রাজ হবে খান খান'। দেশের ধর্ম রাজনীতি নিয়ে মানুষ গেয়ে ওঠেন- 'কতই রঙ্গ দেখি দুনিয়ায়'।
পরিচালক, লেখক, সুরকার, চিত্রশিল্পী হিসেবে তিনি নিজেকে যেভাবে উপস্থাপন করেছেন তা সম্বল করে বাঙালি আজও গর্বিত। ফেলুদার মতো গোয়েন্দার তুলনা হয় শার্লক হোমসের সঙ্গে। তাবড় তাবড় অভিনেতাদের নিয়ে কাজ করেছেন তিনি- উৎপল দত্ত, সৌমিত্র চ্যাটার্জি, মাধবী মুখার্জি, রবি ঘোষ, তুলসী চক্রবর্তী। তাঁর সৃষ্টির সঙ্গে পরিচালক সত্যজিৎ রায় মানুষের মনের এক উজ্জ্বল কোণে বাঁচবেন আরও সহস্রকাল।