কলকাতা, ৫ নভেম্বর: কেওড়াতলা মহাশ্মশানে গানস্যালুটের সঙ্গে সঙ্গেই হয়ে গেল শেষকৃত্য। পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে গেলেন একাধারে বর্ণময় সফল রাজনীতিক, প্রবীণ নেতা তথা কলকাতার প্রাক্তন মেয়র সুব্রত মুখোপাধ্যায় (Subrata Mukherjee)। বাবার কর্মসূত্রে ছেলেবেলাটা কেটেছে বর্ধমানে। তারপরে চলে আসেন কলকাতায়। ছাত্ররাজনীতিতে ছিলেন তুখোড়। অল্পদিনেই মন্ত্রী হয়ে যান। তবুও ছাত্ররাজনীতির প্রতি তীব্র ভালবাসা তাঁকে বেঁধে রেখেছিল। একটা সময় পর দলের প্রয়োজনেই ছাত্রনেতার পদ থেকে সরে দাঁড়ালেন। কখনও সিগারেট খাননি, কিন্তু অনুজদের বলতেন, সিগারেট না খেলে, সিনেমা নিয়ে আড্ডা না মারলে রাজনীতি করবি কী করে? প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সি, সৌমেন মিত্র ও সুব্রত মুখোপাধ্যায়কে বলা হত ত্রয়ী। প্রদেশ কংগ্রেস নেতৃত্ব বলতে এই তিনজনকেই বুঝত বাংলার মানুষ। আরও পড়ুন- Subrata Mukherjee Death: সুব্রতদা আমাদের হিরো, উত্তম কুমার; ফিরহাদ হাকিম
এরপর গঙ্গা দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে। বাংলার রাজনীতিতে এসেছে বিরাট বদল, যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে একদিন তিনি কংগ্রেসের শীর্ষনেতৃত্বের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বিচক্ষণতার প্রমাণ দিয়েছিলেন, সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একদিন তাঁর বিরোধী নেত্রী হয়ে গেলেন। তৈরি হল তৃণমূল কংগ্রেস। কালে কালে মমতার নেতৃত্বকে সম্মান জানিয়ে ঘাসফুল শিবিরে চাঁদের হাট বসল। বলাবাহুল্য, সেই দলে ছিলেন সুব্রতবাবুও। বাদ গেলেন না সৌমেন মিত্র। ফের দাদা বোনের রাজনৈতিক মতান্তর, ফিরে গেলেন কংগ্রেসে। তবে তা অল্প সময়ের জন্যই। ফের প্রত্যাবর্তন, সসম্মানে দাদা সুব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাঁধে মহানাগরিকের দায়িত্ব সঁপলেন বোন মমতা। অত্যন্ত পারদর্শীতার সঙ্গে কলকাতার মেয়র পদের দায়িত্ব সামলালেন সুব্রত মুখোপাধ্যায়। পঞ্চায়েত মন্ত্রী হিসেবেও তিনি দারুণ সফল।
ভোটে জেতার পর একডালিয়ার দুর্গাপুজো নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। মাদুর্গা, তার ছেলেমেয়ে ও অসুরের পোশাকও নিজেই পছন্দ করেছেন। লক্ষ্মীপুজোর পরে চেকআপের জন্য এসেছিলেন এসএসকেএম হাসপাতআলে। চিকিৎসকরা তাঁর শারীরিক পরিস্থিতির কথা চিন্তা করে তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করে নেন। শ্বাসকষ্টের একটা সমস্যা ছিল। ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছিলেন। বুধবার বেডে বসেই দপ্তরের গুরুত্বপূর্ণ ফাইলে সই করেছেন তিনি। একেবারে চনমনে ছিলেন। শুক্রবার অর্থাৎ আজই তাঁর ছুটি হওয়ার কথা। তবে তিনি নিজেই ছুটি নিয়ে আসল বাড়ি রওনা হবেন, কেউ ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ছটা নাগাদ সুব্রতবাবুর সিটিস্ক্যান রিপোর্ট নরমাল আসে। তখন পাশে ছিলেন স্ত্রী ছন্দাবাণী মুখোপাধ্যা ও সুব্রতবাবুর আইনজীবী। আড্ডার মুডে ছিলেন, পরের দিন ফিরবেন বাড়ি। একবার চপমুড়ি খাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেন। আবার চাউমিনও খেতে চান। এরপর উঠে শৌচাগারে যান সুব্রতবাবু। ফেরার পরে আর চনমনে ভাবটা ছিল না। বলতে থাকেন , শরীর খারাপ লাগছে। বুকে ব্যথা অনুভব করছেন। আচমকাই ভেডে ঢলে পড়েন। ছন্দাবাণী মুখোপাধ্যায় চিৎকার করে ডাকিতার ডাকতে বলেন।
জুনিয়র ডাক্তাররা ছুটে এসে বুকে পাম্প করা শুরু করেন। ৪০ মিনিট ধরে চেষ্টা চলে। চিকিৎসকদের মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করা হয়। একবার ইসিজি রুমে নিয়ে যাওয়া হয়। বিশিষ্ট হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ সরোজ মণ্ডলের সঙ্গেও বার্তালাপ চলে। সাড়ে সাতটা নাগাদ এসএসকেএম হাসপাতালের সুপার সুব্রতবাবুর কেবিনে আসেন। কিছুক্ষণ থাকার পর বাইরে গুয়ে বসেন। শত ওষুধ ডাক্তার যে প্রবীণ রাজনীতিককে আর সুস্থ করতে পারবেন না, তা তিনি বুঝে গিয়েছিলেন। একবার হাতও তোলার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তাঁর আর কোনও সাড়া মেলেনি। রাত নটা বেজে ২২ মিনিটে শেষ নিঃ শ্বাস ত্যাগ করেন এই বর্ণময় রাজনীতিক।
বাড়ির পুজো সেরে তড়িঘড়ি এসএসকেএমে পৌঁছে সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের প্রয়াণের খবর ঘোষণা করেন মমতা। দৃশ্যতই শোকস্তব্ধ মমতা জানান, সুব্রতদাকে এভাবে দেখতে তিনি পারবেন না। তাই রাজনৈতিক সতীর্থের শেষযাত্রাতেও সঙ্গ দেননি। বলেছেন, “আলোর দিনে এত অন্ধকার ভাবতে পারিনি। গোয়া থেকে ফিরেই আমি দেখা করতে গিয়েছিলাম। তখন বললেন আবার জেলায় জেলায় যাব। এরপর আমি আজ রাতে বাড়ির কালীপুজোতে শুনলাম কাল ছেড়ে দেওয়া হবে সুব্রতদাকে। কিন্তু, হঠাৎ এই দুঃসংবাদ।”