
গ্রামাঞ্চলের শান্ত-স্নিগ্ধ এক সকাল অথবা ব্যস্ত নাগরিক জীবনে এক সময় ওদের কিচির-মিচির নিয়মিত শোনা যেত। ছোট্ট এই পাখিগুলিকে নিমন্ত্রণ করা হত না, অথচ তারা অযাচিতভাবেই আসত আমাদের কাছে, আর সুন্দর এক স্মৃতি তৈরি করত যা কখনই ভুলবার নয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের জীবন থেকে সেই ছোট্ট বন্ধুরা হারিয়ে গেছে। এক সময় এদের প্রচুর দেখা যেত, আর আজ এদের দেখা মেলাই ভার। হ্যাঁ, চড়ুই পাখির কথা বলা হচ্ছে। এই ছোট্ট প্রাণীগুলির সংরক্ষণের জন্য সকলের মধ্যে সচেতনতা গড়ে তুলতে প্রতি বছর ২০ মার্চ বিশ্ব চড়ুই দিবস (World Sparrow Day 2025) উদযাপন করা হয়।
২০১০ সালে একটি পক্ষী সংরক্ষণ সংগঠন, নেচার ফর এভার বিশ্ব চড়ুই দিবস উদযাপনের সিদ্ধান্ত নেয়। ক্রমহ্রাসমান চড়ুই পাখির বিষয়ে সচেতনতা গড়ে তুলতেই এই উদ্যোগ। পৃথিবীর ৫০টির বেশি দেশে এই সংগঠনটি কাজ করছে। ২০১২ সালে দিল্লির রাজ্য পাখির স্বীকৃতি পায় হাউজ স্প্যারো বা চড়ুই পাখি। সেই সময় থেকেই সারা বিশ্বজুড়ে এদের নিয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু হয়েছে। আজ বিভিন্ন জায়গায় চড়ুই পাখির সংরক্ষণের জন্য নানা কাজ চলছে।
চড়ুই পাখি ছোট্ট একটি প্রাণী হলেও আমাদের বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য বজায় রাখার ক্ষেত্রে এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। বিভিন্ন কীটপতঙ্গকে এরা খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে। ফলে, প্রকৃতিতে এইসব কীটপতঙ্গের সংখ্যাও নিয়ন্ত্রণে থাকে। এছাড়াও, পরাগ সংযোগ এবং বিভিন্ন জায়গায় বীজ ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে চড়ুই পাখির বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। তাদের কারণে জীববৈচিত্র্য যেমন বজায় থাকে, পাশাপাশি গ্রাম-শহরের বাস্তুতন্ত্রের স্বাস্থ্যকর দিকটিও রক্ষা পায়।
চড়ুইয়ের এত গুরুত্ব সত্ত্বেও এরা প্রকৃতি থেকে যেভাবে হারিয়ে যাচ্ছে, তা উদ্বেগের বিষয়। চড়ুই পাখির সংখ্যা হ্রাসের পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। সীসামুক্ত পেট্রোল ব্যবহারের ফলে বিভিন্ন কীটপতঙ্গের ক্ষতি হয়। ফলে, চড়ুই পাখি খাদ্য সঙ্কটে ভোগে। দ্রুত নগরায়নের ফলে এই ছোট্ট পাখিটি তার বাসা তৈরির জায়গাও খুঁজে পায় না। আধুনিক বাড়িতে চড়ুই পাখির বাসা বানানোর জায়গা না থাকায় এরা আরও এক সঙ্কটে ভোগে।
এছাড়াও, কৃষিক্ষেত্রে কীটনাশকের ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় গ্রামাঞ্চলের চড়ুই পাখিও তাদের খাবার খুঁজে পায় না। পাশাপাশি, গাছ কেটে ফেলা এবং কাক ও বেড়ালের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় চড়ুই পাখির অস্তিত্ব সঙ্কটে। ফলে, ছোট্ট এই পাখিটির বেঁচে থাকা খুব কষ্টকর হয়ে পড়েছে।
এইসব উদ্ভুত সঙ্কট থেকে বের হয়ে এসে চড়ুই পাখিকে রক্ষার জন্য বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে যাতে তারা আবারও আমাদের জীবনে ফিরে আসে। পরিবেশবিদ জগৎ কিংখাবওয়ালা ‘সেভ দ্য স্প্যারো’ প্রকল্পের সূচনা করেছেন। তিনি পরিবেশকে রক্ষা করে সুষম উন্নয়নের পক্ষে সওয়াল করে থাকেন। ২০১৭ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এই উদ্যোগকে সমর্থন করায় মানুষের মধ্যে চড়ুই পাখি সংরক্ষণের বিষয়ে সচেতনতা বেড়েছে।
চেন্নাইয়ের কোড়ুগাল ট্রাস্ট অভিনব এক উদ্যোগ নিয়েছে। এই সংগঠন স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের চড়ুই পাখির বাসা বানাতে উৎসাহিত করে। ছেলে-মেয়েরা ছোট্ট ছোট্ট কাঠের বাসা বানায়। সেই বাসায় চড়ুই পাখির জন্য খাবারেরও ব্যবস্থা করা হয়। ২০২০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত কোড়ুগাল ট্রাস্টের উদ্যোগে ১০ হাজারের বেশি চড়ুই পাখির বাসা বানানো হয়েছে। ফলে, এই পাখির সংখ্যাও বেড়েছে। চড়ুই পাখির সংরক্ষণে ছোটদের যুক্ত করার প্রয়োজনীয়তা এই প্রকল্পের মাধ্যমে অনুভূত হয়েছে।
কর্ণাটকের মাইসুরুতে ‘আর্লি বার্ড’ প্রকল্পটি শিশুদের মধ্যে শুরু করা হয়। এই কর্মসূচির আওতায় শিশুদের লাইব্রেরীতে গিয়ে পড়াশোনা করতে উৎসাহিত করা হয়। এছাড়াও তাদের নানা ধরনের কিট দেওয়া হয় যেগুলিতে পাখিদের সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়। এই প্রকল্পের আওতায় শিশুদের গ্রামে নিয়ে যাওয়া হয়। এভাবে তারা চড়ুই সহ অন্যান্য পাখির প্রয়োজনীয়তার কথা উপলব্ধি করতে পারে।
রাজ্যসভার সাংসদ ব্রিজ লাল চড়ুই সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। তাঁর বাড়িতে এই সাংসদ ৫০টি বাসা বানিয়েছেন যেখানে চড়ুই পাখিরা প্রতি বছর ডিম পারে। শ্রী লাল পাখিগুলির জন্য খাবার-দাবারের ব্যবস্থা করেন। প্রধানমন্ত্রী তাঁর এই উদ্যোগের প্রশংসা করেছেন এবং চড়ুই পাখির সংরক্ষণে এটি কতটা গুরুত্বপূর্ণ, সেই বিষয়টিও উল্লেখ করেন।
আমাদের ছোট্ট এই বন্ধুকে রক্ষা করা যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, বিশ্ব চড়ুই দিবস সেটিকেই আরও একবার মনে করিয়ে দেয়। আরও বেশি বনসৃজন, কীটনাশকের ব্যবহার কমানো এবং চড়ুইদের জন্য নিরাপদ বাসস্থান তৈরি করার মতো ছোট্ট ছোট্ট উদ্যোগ নিলে, আমরা আমাদের জীবনে আবারও চড়ুই পাখিকে ফিরিয়ে আনতে পারব। এর মধ্য দিয়ে প্রকৃতির সঙ্গে মানবজাতির সৌহার্দ্য বৃদ্ধি পাবে।