পার্থ প্রতিম চন্দ্র: আগামিকাল, সোমবার দেশে লোকসভা নির্বাচন (Lok Sabha Elections 2024) চতুর্থ দফার ভোটগ্রহণ। এই দফায় দেশের ১০টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে ৯৬টি লোকসভা আসনে ভোটগ্রহণ হবে। অন্ধ্রপ্রদেশ (২৫) ও তেলঙ্গানা (১৭)-র সব কটি আসনে ভোটগ্রহণ হবে সোমবার চতুর্থ দফায়। বাংলায় ৮টি আসনে হবে ভোটগ্রহণ। এ ছাড়াও উত্তর প্রদেশের ১৩টি, মহারাষ্ট্রের ১১টি, মধ্যপ্রদেশের ৮টি, বিহারের ৫টি আসনে ভোটগ্রহণ হবে। পাশাপাশি কাশ্মীরের অন্ততনাগেও হবে ভোট।
বাংলায় ভোটগ্রহণ হবে চারটি জেলার আটটি আসনে। সেগুলি হল- ১) বহরমপুর (মুর্শিদাবাদ), ২) কৃষ্ণনগর (নদিয়া), ৩) রানাঘাট (নদিয়া), ৪) বীরভূম (বীরভূম), ৫) বোলপুর (বীরভূম), ৬) বর্ধমান পূর্ব, ৭) বর্ধমান-দুর্গাপুর ও ৮) আসানসোল আসনে। এই দফায় বাংলায় বেশ কিছু হেভিওয়েট আসনে ভোটগ্রহণ হবে। গত লোকসভা নির্বাচনে এই আটটি আসনের মধ্যে তৃণমূল চারটিতে জিতেছিল, বিজেপি পেয়েছিল ৩টি আর কংগ্রেসের দখলে ছিল বহরমপুর আসন। আরও পড়ুন-এবার চতুর্থ দফা, সোমবার রাজ্যে ভোট যে সব জায়গায়
আসুন এক নজরে দেখে নেওয়া যাক সোমবার চতুর্থ দফায় দেশের যে সব তারকা প্রার্থীদের ভাগ্যপরীক্ষা হতে চলেছে-
অধীর রঞ্জন চৌধুরী (বহরমপুর, পশ্চিমবঙ্গ): টানা ২৫ বছর ধরে তিনি বহরমপুর লোকসভায় জিতে আসছেন। গত ২৫ বছরে দেশ, রাজ্য রাজনীতির গঙ্গা দিয়ে কত জল যে বয়ে গিয়েছে ঠিক নেই। দেশে বিজেপি ধীরে ধীরে ছড়িয়ে গিয়ে নিজেদের জোরেই ভারত জয় করেছে। গান্ধী পরিবারকে ম্লান করে নরেন্দ্র মোদী দেশের মসনদে জমনিয়ে বসেছেন। বঙ্গ রাজনীতিতে সিপিএমের ৩৪ বছরের শাসন শেষে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জনপ্রিয়তার শিখরে উঠেছেন। কিন্তু এত সব ঘটনার পরেও বহরমপুর সেই অধীর ম্যাজিকেই আবদ্ধ রয়েছে। অনেক চেষ্টা করেও তাঁকে হারানো যায়নি। তবে এবার অধীরের লড়াইটা কঠিনতম। কারণ বহরমপুর লোকসভা কোনও বিধানসভায় কংগ্রেসের বিধায়ক নেই। এবার মুর্শিদাবাদের বহরমপুরে মূল লড়াইটা ব্র্যান্ড অধীর চৌধুরী ও তৃণমূলের মধ্যে। অধীরের বিরুদ্ধে তৃণণূল এবার প্রার্থী করেছে প্রাক্তন ক্রিকেটার ইউসুফ পাঠান-কে। মুর্শিদাবাদ জেলায় কংগ্রেসকে নিশ্চিহ্ন করতে পারলেও বহরমপুরে অধীর গড়ে এর আগে কখনও ভাঙন ধরাতে পারেননি দিদি।
অখিলেশ যাদব (কনৌজ, উত্তর প্রদেশ): একেবারে শেষ মুহূর্তে কনৌজ থেকে ভোটে লড়ার সিদ্ধান্ত নেন সমাজবাদী পার্টির প্রধান। গত লোকসভায় আজমগড় লোকসভা থেকে লড়ে জিতেছিলেন অখিলেশ। কিন্তু ইউপি বিধানসভায় নিজর কেন্দ্রে জেতার পর আজমগড় লোকসভায় সাংসদ হিসেবে পদত্যাগ করেন অখিলেশ। এরপর উপনির্বাচন হলে সেখানে এসপি-র প্রার্থীকে হারিয়ে সাংসদ হন বিজেপির দীনেশ লাল যাদব। এবার আজমগড় নয়, সমাজবাদী গড় হিসেবে পরিচিত কনৌজ থেকে লড়ছেন এসপি প্রধান। গতবার এখানে অখিলেশের স্ত্রী ডিম্পলকে ১৩ হাজার ভোটে হারিয়েছিলেন বিজেপির সুব্রত পাঠক। স্ত্রী-র হারের শোধ তুলতে বিজেপির সাংসদ সুব্রত পাঠকের বিরুদ্ধে অখিলেশ লড়ছেন সাইকেল প্রতীকে।
দিলীপ ঘোষ (বর্ধমান-দুর্গাপুর, পশ্চিমবঙ্গ): বঙ্গ বিজেপি-র এক সময়ের সর্বেসর্বা দিলীপ ঘোষ দলে কোণঠাসা বলে অনেকেই বলছেন। মেদিনীপুর থেকে দিলীপ ঘোষকে লড়তে পাঠানো হয়েছে বর্ধমান-দুর্গাপুরে। গতবার এই আসনে অল্প ব্যবধানে জিতেছিলেন বিজেপি-র বর্ষীয়ান নেতা সুরিন্দর সিং আলুওয়ালিয়া। ২০২১ বিধানসভা পর বর্ধমান দুর্গাপুরে তৃণমূল ব্যাপক শক্তিশালী হয়েছে। এবার এই আসন ধরে রাখতে 'অপরাজেয়'দিলীপকে পাঠিয়েছে গেরুয়া শিবির। দিলীপের প্রতিপক্ষ ১৯৮৩ বিশ্বকাপ জয়ী দলের সদস্য কীর্তি আজাদ। প্রথমবার মেদিনীপুরের বাইরে লড়ে জিততে পারবেন কি দিলীপ?
ইউসুফ পাঠান (বহরমপুর, পশ্চিমবঙ্গ): বাইশ গজে অনেক বিস্ফোরক খেলেছেন। দেশের জার্সি থেকে আইপিএলে কেকেআর-ইউসুফ পাঠানের বিস্ফোরক ব্যাটিং সবাইকে মুগ্ধ করেছে। এবার অধীর গড় বহরমপুরে দিদির দলের বৈতরণী পাড় করার দায়িত্ব ইউসুফের কাঁধের। রাজনীতির পিচে প্রথমবার ব্যাট করতে নেমে ছক্কা হাঁকাতে পারবেন কি ইউসুফ? নাকি অধীরের বাউন্সারে ক্লিন বোল্ড হবেন পাঠান ব্রাদার।
মেহবুবা মুফতি (অনন্তনাগ, জম্মু-কাশ্মীর): সংবিধানের ৩৭০ ধারা প্রত্যাহারের পর পিডিপি নেত্রী তথা জম্মু-কাশ্মীরের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতি-কে গৃহবন্দি থাকতে হয়েছিল। এরপর থেকে তীব্র বিজেপি বিরোধীর ভূমিকা নিয়ে নেমেছেন মেহবুব মুফতি। সোমবার মেহবুবা-র অগ্নিপরীক্ষা। অন্ততনাগ লোকসভায় এক সময়ের সাংসদ মেহবুবার কাছে তাঁর গড় পুনরুদ্ধারের চ্যালেঞ্জ। এবার কাশ্মীরের কোনও আসনেই প্রার্তী দেয়নি বিজেপি।
আসাউদ্দিন ওয়েইসি (হায়দরাবাদ, তেলঙ্গানা): চারমিনারের শহরে গত ৪০ বছর ধরে ওয়েইসি পরিবারের দাপট। গত ১২টি লোকসভা আসনে হায়দরাবাদে জিতে আসছেন হয় সুলতান সালাউদ্দিন ওয়েইসি বা তার ছেলে আসাউদ্দিন ওয়েইসি। ১৯৮৪-২০০৪ হায়দরাবাদের সাংসদ ছিলেন সালাউদ্দিন ওয়েইসি। তারপর ২০০৪ থেকে টানা সব কটা লোকসভা নির্বাচনে জিতে আসছেন আসাউদ্দিন ওয়েইসি। ভারতের রাজনীতিতে আর কোনও লোকসভা কেন্দ্রে বাবা ও ছেলের টানা ৪০ ধরে জেতার নজির নেই। অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখানো ওয়েইসি-র এবার প্রতিপক্ষ বিজেপি-র মাধবী লতা-কে নিয়ে দিল্লির মিডিয়া এবার খুব মাতামাতি করছে। তবে এবারও ওয়েইসি ফেভারিট বলেই রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন। গত লোকসভায় নিকটতম বিজেপি-র প্রতিদ্বন্দ্বী ভগবন্ত রাওয়ের বিরুদ্ধে ওয়েইসি জিতেছিলেন ২ লক্ষ ৮০ হাজারের মত ভোটে। এবার তাঁর মার্জিন বাড়ে কি না সেটাই দেখার, এমনটাই দাবি তার দল মিম-এর নেতা-কর্মীদের।
ওয়াই এস শর্মিলা ( কাদাপা, অন্ধ্রপ্রদেশ): অন্ধ্র প্রদেশের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী জগনমোহন রেড্ডি-র বোন তথা রাজ্যে কংগ্রেসের প্রভাবশালী নেতা ওয়াইএস আর রেড্ডি-র মেয়ে ওয়াই এস শর্মিলা লড়বেন তাঁর পরিবারের গড় হিসেবে পরিচিত কাদাপা থেকে। অন্ধ্র কংগ্রেসের প্রধান শর্মিলা-কে জেতাতে প্রচার করেছেন রাহুল গান্ধী। অন্ধ্রে গত দশ বছরে কংগ্রেস সাইনবোর্ডে পরিণত হয়েছে। তবু এরই মাঝে হাতের আস্থা শর্মিলা।
মহুয়া মৈত্র (কৃষ্ণনগর, পশ্চিমবঙ্গ): তিনি বিতর্কিত। তিনি চর্চিত। এবার তাঁর চ্য়ালেঞ্জ সম্ভবত তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে কঠিনতম লড়াইয়ের। কৃষ্ণনগর দখলে রাখতে হলে তৃণমল নেত্রী মহুয়া মৈত্র-কে হারাতে হবে বিজেপি-র 'রাজমাতা' প্রার্থী অমৃতা রায়-কে। মহুয়া একের পর এক বিতর্কে জড়ালও মমতা সব সময় মহুয়াকে আড়াল করেছেন। দলের নিচুতলায় একাংশে তাঁকে নিয়ে ক্ষোভ থাকা সত্ত্বেও দিদির আশীর্বাদ পেয়েছেন মহুয়া। তবে এবার তাঁকে জিততেই হবে। না হলে একের পর এক মামলায় কোণঠাসা মহুয়া তলিয়ে যাবেন। আর কৃষ্ণনগরে জিতে গেলে তিনি ফের নয়া উদ্যমে ঝাঁপাতে পারবেন।
অর্জুন মুন্ডা (খুন্তি, ঝাড়খণ্ড): ঝাড়খণ্ডে বিজেপি-র প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অর্জুন মুন্ডা এবার প্রার্থী খুন্তি থেকে। খুন্তিতে সুস্বাদু জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী অর্জুন মুন্ডা।
শত্রুঘ্ন সিনহা (আসানসোল, পশ্চিমবঙ্গ): বলিউডের খামোশ অভিনেতা শত্রুঘ্ন সিনহা প্রথমবার আসানসোলে জিতেছিলেন বাবুল সুপ্রিয় বিজেপি ছেড়ে এসে সাংসদ হিসেবে পদত্যাগের পর। এবার শত্রুঘ্নের সামনে বিজেপি-র বর্ষীয়ান নেতা সুরিন্দর সিং আলুওয়ালিয়া। শত্রুঘ্ন পারবে কি গড় ধরে রাখতে?
গিরিরাজ সিং (বেগুসরাই, বিহার): কেন্দ্রীয় মন্ত্রী গিরিরাজ সিংয়ের কাছে গড় ধরে রাখার চ্যালেঞ্জ।
শতাব্দী রায় (বীরভূম, পশ্চিমবঙ্গ): আরও একবার বীরভূম থেকে লড়ছেন শতাব্দী রায়। ২০০৯ সাল থেক বীরভূম লোকসভা থেকে লড়ে জিতে আসছেন শতাব্দী। টানা চতুর্থবার সাংসদ হওয়ার চ্যালেঞ্জ টলিউডের তারকা অভিনেত্রীর সামনে। কেষ্টহীন বীরভূমে শতাব্দির সেরা জয় আসবে কি?