Shubhanshu Shukla: মহাকাশে ইতিহাস গড়ে পৃথিবীর বুকে ফিরছেন ভারতের মহাকাশচারী গ্রুপ ক্যাপ্টেন শুভাংশু শুক্লা। রাকেশ শর্মার দীর্ঘ ৪১ বছর পর, দ্বিতীয় ভারতীয় হিসেবে শুভাংশু শুক্লা মহাকাশে যান। অ্যাক্সিয়ম মিশন ৪ (Ax-4) এর অংশ হিসেবে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন (ISS) এর উদ্দেশে যাত্রা করেছিলেন তিনি। গত ২৫ জুন ফ্লোরিডার কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে স্পেসএক্স-এর 'ড্রাগন' ক্যাপসুলে চড়ে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেন। ২৮ ঘণ্টার যাত্রার পর ২৬ জুন তিনি ও তাঁর দল আইএসএস-এ পৌঁছান। গত ২১ দিন ধরে গবেষণার কাজ সেরে প্রায় ২৬৩ কেজি বৈজ্ঞানিক উপাদান নিয়ে ফিরছেন শুভাংশু। প্রথম ভারতীয় হিসেবে আইএসএস-এ পা রাখার কৃতিত্ব গড়েছেন শুভাংশু। এই মিশনের জন্য ইসরো প্রায় ৫৫০ কোটি টাকা (৬৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার) খরচ করেছে, যা ভারত সরকার এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের সহায়তায় সম্পন্ন হয়েছে।
প্রায় ১৬ ঘণ্টার যাত্রা শেষে শুভাংশু শুক্লা ক্রু ড্রাগন ক্যাপসুলে করে পৃথিবীতে পৌঁছবেন। এই ড্রাগন মহাকাশযানে রয়েছে প্রায় ২৬৩ কেজি বৈজ্ঞানিক উপাদান, যার মধ্যে ৬০টিরও বেশি মহাকাশ গবেষণার তথ্য ও নমুনা রয়েছে। আজ, সোমবার ভারতীয় সময় বিকেলে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন থেকে ‘ড্রাগন’ ক্যাপসুল আনডক করে পৃথিবীর উদ্দেশে যাত্রা শুরু করবেন শুভাংশ ও তার দল। এই ফিরতি যাত্রা একটি জটিল প্রক্রিয়া, যার মধ্যে রয়েছে ‘রেট্রোগ্রেড বার্ন’—যা ক্যাপসুলের গতি কমিয়ে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশের পথ প্রস্তুত করে। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশের সময় ক্যাপসুলের গতি ঘণ্টায় ২৮,০০০ কিলোমিটার থেকে কমে ২৪ কিলোমিটারে নেমে আসবে।
আসুন জেনে নেওয়া যাক কীভাবে পৃথিবীর বুকে ফিরবেন শুভাংশু শুক্লা
ধাপ ১: পৃথিবীতে ফেরার প্রস্তুতি
মহাকাশযাত্রার নির্দিষ্ট সময়সীমা থাকে। মিশন শেষের কিছুদিন আগেই মহাকাশচারীরা রিটার্ন ট্রেনিং শুরু করেন। খাবার, নমুনা, ও গবেষণার ফলাফল গুছিয়ে নেওয়া হয়। সয়ুজ (Soyuz) বা স্পেসএক্স-এর ড্রাগন ক্যাপসুলের মতো রিটার্ন যান প্রস্তুত করা হয়। প্রস্তুতি ও পরীক্ষা-নিরীক্ষামহাকাশচারীরা ISS-এর মিশন শেষ করে ফেরার আগে প্রচুর প্রস্তুতি নেন। তারা তাদের স্পেসস্যুট, সরঞ্জাম আর সয়ুজ (Soyuz) বা অন্য কোনো মহাকাশযান যেটা দিয়ে ফিরবেন, সেটার সবকিছু ঝকঝকে করে পরীক্ষা করেন। ISS-এর ভেতরে সব গবেষণার ডেটা, নমুনা আর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র প্যাক করা হয়। এছাড়া, মহাকাশচারীদের শরীর কীভাবে পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণে ফিরে আসবে, তার জন্য শারীরিক পরীক্ষাও করা হয়।
দেখুন পুরো প্রক্রিয়াটি
ধাপ ২: স্পেস স্টেশন থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া
(সময় লাগে: প্রায় ৩ থেকে ৪ ঘন্টা)
মহাকাশযানে প্রবেশ ও বিচ্ছেদযখন ফেরার সময় হয়, মহাকাশচারীরা সয়ুজ বা অন্য কোনো মহাকাশযানে উঠে পড়েন। সয়ুজে তিনটা অংশ থাকে: অরবিটাল মডিউল, ডিসেন্ট মডিউল আর সার্ভিস মডিউল। তারা ডিসেন্ট মডিউলে বসেন, যেটা পৃথিবীতে ফিরবে। সবকিছু বন্ধ করে, হ্যাচ সিল করে তারা ISS থেকে বিচ্ছেদ ঘটান। এটা অনেকটা আতমকা ঝাঁকুনির মতো অনুভূত হয়, মনে হয় যেন আচমকা একটা ট্রেন হঠাৎ থেমে যায়। স্বয়ংক্রিয় কমান্ড বা মহাকাশচারীর হাতে থাকা নিয়ন্ত্রণে এটি ঘটে।
ধাপ ৩: পৃথিবীর কক্ষপথে ঢোকার জন্য নির্দেশ
স্পেস স্টেশনের কক্ষপথ অনেক উপরে। তাই পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে ঢোকার জন্য ক্যাপসুলের গতি ও দিক ঠিক করতে হয়। এর জন্য রকেট ইঞ্জিন চালিয়ে “ডিওরবিট বার্ন” (Deorbit Burn) করা হয়। এটা ক্যাপসুলকে নিচে নামার রাস্তা তৈরি করে দেয়।
ধাপ ৪: পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ
মহাকাশযানটা পৃথিবীর দিকে নামতে শুরু করে। এই সময়টা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। যানটা প্রায় ২৮,০০০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা গতিতে বায়ুমণ্ডলে ঢোকে। বায়ুমণ্ডলের সঙ্গে ঘর্ষণে যানের বাইরের অংশ প্রচণ্ড গরম হয়ে যায়, প্রায় ১,৫০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস! তবে, যানের হিট শিল্ড সবাইকে রক্ষা করে। এই সময় মহাকাশচারীরা প্রচণ্ড ঝাঁকুনি আর তাপ অনুভব করেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ ধাপ এটি। যখন ক্যাপসুল পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করে, তখন ঘর্ষণের ফলে বাইরের তাপমাত্রা ১৬৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত উঠে যায়! এই গরম থেকে বাঁচাতে থাকে হিট শিল্ড। এই সময়ে ক্যাপসুলের সঙ্গে পৃথিবীর যোগাযোগ কিছু সময়ের জন্য বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
ধাপ ৫: প্যারাশুট খোলা ও অবতরণ
বায়ুমণ্ডলে নেমে আসার সময় সয়ুজের প্যারাশুট খুলে যায়, যা গতি অনেকটা কমিয়ে দেয়। প্রথমে ছোট প্যারাশুট, তারপর বড় প্যারাশুট খোলে। বায়ুমণ্ডলের ঘনত্ব বাড়লে, নির্ধারিত উচ্চতায় ক্যাপসুলের প্যারাশুট খুলে যায়। ধাপে ধাপে তিনটি প্যারাশুট খোলে—ড্রগ, মেইন ও ফাইনাল প্যারাশুট—যার ফলে গতিবেগ কমে যায়। এরপর মাটির কাছাকাছি এলে রকেট ইঞ্জিন জ্বলে, যাতে অবতরণটা নরম হয়। সাধারণত সয়ুজ কাজাখস্তানের মরুভূমিতে অবতরণ করে। অবতরণের সময় মহাকাশচারীরা একটা বড় ঝটকা অনুভব করেন, যেন গাড়ি দিয়ে কিছুতে ধাক্কা লাগে।
ধাপ ৬: মাটিতে অবতরণ
পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশের সময় ক্যাপসুলের গতি থাকবে ঘণ্টায় ২৮,০০০ কিলোমিটার থেকে কমে ২৪ কিলোমিটারে নেমে আসবে। এরপর দুটি প্যারাশুট—প্রথমে একটি ছোট এবং পরে মূল প্যারাশুট—ক্যাপসুলকে ধীরে ধীরে ক্যালিফোর্নিয়ার উপকূলে সমুদ্রে অবতরণ করাবে। নাসার তথ্য অনুযায়ী, ১৫ জুলাই ভারতীয় সময় ভোর ৩টায় এই ‘স্প্ল্যাশডাউন’ সম্পন্ন হওয়ার কথা।
ধাপ ৭: উদ্ধার অভিযান
উদ্ধার ও পরীক্ষামাটিতে নামার পর উদ্ধারকারী দল তড়িঘড়ি পৌঁছে যায়। তারা মহাকাশচারীদের সয়ুজ থেকে বার করে তাঁবুতে নিয়ে যায়। সেখানে প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা হয়। মহাকাশে অনেকদিন থাকার পর শরীর মাধ্যাকর্ষণে অভ্যস্ত হতে সময় লাগে, তাই তাদের হাঁটতে বা দাঁড়াতে সাহায্য করা হয়। এরপর তাদের হাসপাতালে নিয়ে আরও পরীক্ষা করা হয়, যাতে শরীর ঠিক আছে কি না, সেটা নিশ্চিত করা যায়। পৃথিবীতে ফেরার পর শুভাংশু ও তাঁর সহযাত্রীদের সাত দিনের কোয়ারেন্টাইন এবং পুনর্বাসন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। মাধ্যাকর্ষণহীন পরিবেশ থেকে পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণে ফিরে আসার জন্য এই প্রক্রিয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ