২০১৪ এবং ২০১৯ দুই লোকসভা ভোটে জয়ের পর টানা দশ বছর দেশের প্রধানমন্ত্রীর কুর্সিতে বসে রাজ করেছেন নরেন্দ্র মোদী (Narendra Modi)। পরপর দুবার পূর্ণ মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী থাকার পর ২০২৪-এ আরও একবার প্রধানমন্ত্রী হতে চলেছেন মোদী। যা বিগত ছয় দশকে প্রথম। শুক্রবার দিল্লির সংসদ ভবনে বৈঠকে বসেছিল এনডিএ জোটের শরিকেরা। সেখানেই সর্বসম্মতিক্রমে সংসদের দলীয় নেতা হিসাবে নির্বাচিত হন নমো। ২০২৩ সালে প্রধানমন্ত্রীর গদিতে নয় বছর পূর্ণ করেছিলেন নরেন্দ্র মোদী। বিগত ন'য় বছরে এনডিএ শাসনের মূল উদ্যোগ এবং কৃতিত্বগুলিকে তুলে ধরে প্রচারের স্বার্থে ১৪৩ পাতার একটি বই প্রকাশ করেছিল বিজেপি সরকার। সেই বইয়ের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘সেবা, সুশাসন ও গরিব কল্যাণ’ (Seva Sushasan Garib Kalyan)।
দেশের পরিকাঠামো থেকে শুরু করে বিদেশ নীতি, সামাজিক ন্যায়বিচার, অর্থনীতি যা কিছু সিদ্ধান্ত গত নয় বছরের শাসনে মোদী সরকার নিয়েছে সেই সমস্ত খুঁটিনাটি ওই বইয়ে তুলে ধরা হয়। তৃতীয়বারের জন্যে প্রধানমন্ত্রীর পদে নরেন্দ্র মোদীর শপথ গ্রহণের আগে আরও একবার নমো-র সংকল্প গুলো ঝালিয়ে নেওয়া যাক।
১) দরিদ্র এবং প্রান্তিকদের জন্যে উদ্যোগঃ
বইটিতে বলা হয়েছে, 'কাউকে পিছিয়ে রাখা উচিৎ নয়' এই আদর্শ নিয়ে ক্ষমতায় আসার পর থেকে দেশের গরিব এবং পিছিয়ে পড়া মানুষদের জন্যে কাজ করে চলেছে মোদী সরকার। দেশের ৮০ কোটি মানুষ প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ অন্ন যোজনার অধীনে বিনামূল্যে খাদ্যশস্য পাচ্ছেন। এছাড়া ১১.৪ কোটিরও বেশি পরিবারকে জলের কলের সংযোগ দেওয়া হয়েছে। স্বচ্ছ ভারত অভিযানের অধীনে ১১.৭২ কোটি শৌচালয় তৈরি করা হয়েছে। এছাড়াও কীভাবে দেশের কোটি কোটি ঘরে এলপিজি গ্যাস, বিদ্যুৎ, বীমা, ইত্যাদি প্রদান করা হয়েছে সেকথা ওই বইতে তুলে ধরা হয়েছে।
২) কৃষক কল্যানঃ
গত নয় বছরে মোদীর শাসনকালে ভারতীয় কৃষি খাতে একটি দৃষ্টান্তমূলক পরিবর্তন হয়েছে বলে উল্লেখ রয়েছে ওই বইতে। মোদীর উদ্যোগে কৃষি ক্ষেত্রে আধুনিকতা এবং বিজ্ঞানের ছোঁয়ায় তা আরও সমৃদ্ধ হয়েছে। ভারতের কৃষক শুধু দেশবাসীর জন্যে সফল ফলাচ্ছে তাই নয়, তাঁদের ফসল পৌঁছে যাচ্ছে বিদেশের বাজারে। প্রধানমন্ত্রীর কিষাণ সম্মান নিধি প্রকল্পের অধীনে প্রতি বছরে কৃষকদের সরাসরি ৬০০০ টাকা করে দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া ২০১৪ সাল থেকে কৃষি বাজেট ৫.৭ গুন বৃদ্ধি পেয়েছে।
৩) নারী ক্ষমতায়নঃ
মোদীর শাসনে গত ৯ বছরে দেশের মহিলারা অনেক বেশি স্বনির্ভর হয়েছে বলে উল্লেখ রয়েছে ‘সেবা, সুশাসন ও গরিব কল্যাণ’ বইটিতে। মহিলা পুলিশকর্মীদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ক্রীড়া ক্ষেত্রে মহিলাদের সুযোগ সুবিধা অনেক বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। যাতে পুরুষদের পাশাপাশি দেশের মহিলারাও আন্তর্জাতিক মঞ্চে ভারতের নাম উজ্জ্বল করতে পারে। মোদীর শাসনকালে মাতৃত্বকালীন ছুটি ১২ সপ্তাহ থেকে বাড়িয়ে ২৬ সপ্তাহ করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী মাতৃ বন্দনা যোজনার অধীনে ৩ কোটিরও বেশি মহিলাকে অর্থ প্রদান করা হচ্ছে।
৪) বৈদেশিক নীতিঃ
গত ৯ বছরে মোদীর বিদেশ নীতি বেজায় প্রশংসিত হয়েছে এই বইতে। জম্মু কাশ্মীর থেকে ৩৭০ ধারা এবং ৩৫(এ) ধারা অপসারণ মোদী সরকারের ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত হিসাবে গণনা করা হয়। মোদীর শাসনে সীমান্তে ভারতের নিরাপত্তা অনেক বেশি কড়া হয়েছে জার ফলে সন্ত্রাসের ঘটনা হ্রাস পেয়েছে বলেই উল্লেখ রয়েছে। এছাড়া যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশগুলোতে আটকে পড়া ভারতীয়দের উদ্ধারে তৎপরতার সঙ্গে ভূমিকা পালন করে চলেছেন মোদী।
৫) কোভিড পরিবর্তী মোকাবিলাঃ
২০২০ সালে করোনা (Corona Virus) অতিমারির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছেন মোদী। ওই বইতে উল্লেখ, কোভিডকে ঘিরে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জন্যে নানা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন তিনি। যেমন, অক্সিজেন সরবরাহের জন্য ৯০০টি অক্সিজেন এক্সপ্রেস ট্রেন চালানো। ক্রায়োজেনিক ট্যাঙ্কার পরিবহনে বিমানবাহিনীর ব্যবহার, ৪০০০-এর বেশি রেলের কোচকে আইসোলেশনের কাজে ব্যবহার, ১,৫০০টির বেশি পিএসএ প্ল্যান্টের অনুমোদন। এছাড়া প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীনে দু ছরের কম সময়ের মধ্যে দেশের ২.২ বিলিয়ন মানুষের কাছে কোভিড ভ্যাকসিনের ডোজ পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়েছে।
৬) উন্নত জীবনধারাঃ
‘সেবা, সুশাসন ও গরিব কল্যাণ’ বইতে উল্লেখ রয়েছে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই নাগরিকদের দৈনন্দিন জীবনধারায় উন্নতি ঘটাতে মনোনিবেশ করেছেন মোদী। আর সেই লক্ষ্যেই প্রধানমন্ত্রী 'সবকা সাথ, সবকা বিকাশ, সবকা বিশ্বাস, সবকা প্রয়াস'এর সংকল্প নিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার মাধ্যমে ঘর, শৌচালয়, গ্যাস, জলের কল, বিদ্যুৎ, সাশ্রয়ী মূল্যে স্বাস্থ্যসেবা ইত্যাদি প্রদান করে চলেছেন মোদী। প্রায় ১.১৬ কোটি মানুষ 'UDAN' এর অধীনে সাশ্রয়ী মূল্যে বিমান ভ্রমণ থেকে উপকৃত হয়েছে। ইন্টারনেটের খরচ ৯৭ শতাংশ কমিয়ে আনা হয়েছে।
৭) অর্থনীতিঃ
বিগত কয়েক বছর যাবত বিশ্বের অর্থনৈতিক অবস্থা বেশ সঙ্কটজনক ছিল। বিশেষ করে রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধের পর থেকে। তবে বিশ্বের অর্থনীতি খানিক টালমাটাল খেলেও ভারতের অর্থনীতিতে সেই প্রভাব ফেলতে দেননি মোদী। জিএসটি, মূলধন ব্যয় বৃদ্ধি, রেকর্ড হারে রপ্তানির পাশাপাশি ২০২২ সালে রিয়েল টাইম ডিজিটাল পেমেন্টের ৪৬ শতাংশ হয়েছিল ভারতেই। এছাড়া ওই বইতে আরও যোগ করা হয়েছে, মাসিক জিএসটি সংগ্রহ ২০২৩ সালের এপ্রিলে সর্বকালের সর্বোচ্চ ১.৮৭ লক্ষ কোটি টাকায় পৌঁছয়। ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে ৭৭০ কোটি বিলিয়ন ডলারের পণ্য এবং পরিষেবা রপ্তানি হয়েছে ভারত থেকে। রপ্তানির ক্ষেত্রে বৈদ্যুতিক যন্ত্রের চাহিদা ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
৮) পরিবহণ ও পরিকাঠামোঃ
২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ভারতকে পরিকাঠামোগত ভাবে আরও মজবুত করার সংকল্প নেন মোদী। ২০১৪ সাল থেকে সড়ক পরিবহন এবং হাইওয়ে বাজেটে বরাদ্দের ক্ষেত্রে ৫০০ শতাংশ বৃদ্ধি করেছে তাঁর সরকার। দেশজুড়ে ছুটে বেরাচ্ছে ৪০০টিরও বেশি বন্দে ভারত এক্সপ্রেস।
৯) স্বাস্থ্যঃ
‘সেবা, সুশাসন ও গরিব কল্যাণ’ বইতে উল্লেখ করেছে, ২০১৪ সালে মোদী ক্ষমতায় আসার পর থেকে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় ব্যাপক অগ্রগতি এনেছেন। কেন্দ্র আয়ুষ্মান ভারত প্রধানমন্ত্রী জন আরোগ্য যোজনা চালু করেছে। যা বিশ্বের বৃহত্তম স্বাস্থ্য বীমা কর্মসূচি। ২২ কোটিরও বেশি মানুষ এই যোজনার দ্বারা উপকৃত হয়েছেন। ৯,০০০ এর বেশি জন ঔষধি কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়া মেডিক্যাল পড়ুয়াদের কথা ভেবে ৯,৬৬৩টি আসন বাড়ানো হয়েছে। গত নয় বছরে মোদী সরকার বেশ কয়েকটি রাজ্যে নতুন AIIMS প্রতিষ্ঠা করেছে। এমনকি বিপুল সংখ্যক নতুন মেডিকেল কলেজ তৈরি করেছে।
১০) ডিমনিটাইজেশন বা নোটবন্দিঃ
ক্ষমতায় আসার মাত্র ২ বছরের মধ্যে মোদীর অন্যতম সাহসী সিদ্ধান্ত ছিল ৫০০ এবং ১০০০ এর নোট বাতিল। ২০১৬ সালের নভেম্বর মাসে রাতারাতি ডিমনিটাইজেশন চালু করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। টাকার কালোবাজারি রুখতে সেই বছর ৮ নভেম্বরের মাঝ রাত থেকেই সমস্ত চালু ৫০০ এবং ১০০০ এর নোট অবৈধ ঘোষণা করেছিলেন মোদী।