কলকাতা, ১০ জুন: লোকসভার ফল দেখে মাথায় হাত বঙ্গ বিজেপি কর্মী-সমর্থকদের। ১৩ বছর সরকারে থাকা মমতা বন্দ্য়োপাধ্যায়ের ওপর বাংলার মানুষ ক্ষুব্ধ এমনটা ভোটের আগে বিজেপির সমীক্ষায় পরিষ্কার ছিল। মমতা সরকারের দুর্নীতি, রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে ইস্যু করে বাংলায় অন্তত ৩০-৩২টি লোকসভা আসনে জয়ের আশায় ছিল বিজেপি। অমিত শাহ তো একটা সময় বঙ্গ বিজেপি নেতাদের ৩৫টি লোকসভা আসনে জয়ের টার্গেটও দিয়েছিলেন। পরে অবশ্য সেটা কমে ৩০-৩২ এ এসে দাঁড়ায়। মোদী সরকারের পক্ষে বলা চ্যানেলগুলির এক্সিট পোলেও তেমনই দেখানো হয়েছিল। বঙ্গ বিজেপি নেতাদের হিসেব ছিল খুব কম হলেও ২২-২৫টি লোকসভা আসনে তারা জিতবেন।
বঙ্গ বিজেপির হিসেব ছিল, উত্তরবঙ্গ, জঙ্গলমহলে গতবারের ভাল ফল ধরে রেখে কলকাতা, দুই ২৪ পরগণা, হাওড়ায় মমতা গড় হিসেবে পরিচিত বেশ কিছু আসনে জিতে চমকে দেওয়া। কিন্তু বাস্তব বড় কঠিন। বাংলায় দিদি ঝড়ে উড়ে গেলেন মোদী। অর্জুন সিং-য়ের ব্যক্তিগত ক্যারিশ্মাতেও ব্যারাকপুরে জেতা হল না বিজেপির। তাপস রায়ের মত তৃণমূলের বিদ্রোহীকে টিকিট দিয়েও কলকাতায় সেই শূন্য। দমদম, যাদবপুরে প্রার্থী ঘোষণার পর জয়ের আত্মবিশ্বাস ঝরে পড়েছিল বিজেপি নেতাদের গলায়। কিন্তু প্রচার থেকে ভোট-এই দুটি কেন্দ্রেই কোনওতেই এঁটে না পাওয়ার ফলে হারতে হল পদ্ম শিবিরকে। হাওড়ায় অনেক আশা করেও ফল লাভ হল না। লকেট যতই প্রচারে ঝড় তুলুন, হুগলিতে জয়ের রচনা লিখল তৃণমূল। আরামবাগে নিশ্চিত জয় মনে করা হলেও, সেখানে ভোটারদের মিতালি হল তৃণমূলের সঙ্গেই। আরও পড়ুন- দেশের ১৩টি বিধানসভা কেন্দ্রে উপনির্বাচনের দিনক্ষণ জানাল কমিশন, রয়েছে রাজ্যের চার বিধানসভাও
শ্রীরামপুর, উলুবেরিয়া, ডায়মন্ড হারবার, মথুরাপুর, জয়নগর নিয়ে বড় আশা না থাকলেও অঘটন একটা ঘটতে পারে বলে সামান্য আশা করেছিলেন বিজেপি-র কর্মী সমর্থকরা। কিন্তু সে সব জায়গায় পুরো ব্যর্থ হল পদ্ম শিবির। যে সন্দেশখালি কাণ্ডের কথা প্রচার করে দেশজুড়ে ঝড় তুলতে পেরেছিলেন শুভেন্দু অধিকারী-রা, সেখানে স্টিং কাণ্ডের পর ফল হিতে বিপরীত হল। বসিরহাটে রেকর্ড ভোটে হারলেন সন্দেশখালির গৃহবধূ তথা বিজেপি প্রার্থী রেখা পাত্র। বারাসতেও আশায় জল ঢালল কাকলি ঘোষ দস্তিদারের জয়। কৃষ্ণনগরে মহুয়া মৈত্র-র জয়টাও হতাশ করেছে বিজেপিকে।
তবে রানাঘাট, বনগাঁ-র জয়টা কিছুটা হলেও স্বস্তি ফিরেছে। যদিও মতুয়া গড়ে শান্তনুর জয়ে ব্যক্তিগত ক্যারিশ্মার অবদানই বেশী বলে ধরা হচ্ছে। বালুরঘাটে বিপ্লব মিত্র-র মত নেতাকে হারিয়ে সুকান্ত মজুমদারের জয়, কিংবা পাহাড়ে ফের অনায়াসে জেতাটা মরুদ্যান হিসেবে দেখছে গেরুয়া শিবির। জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার, রায়গঞ্জ ধরে রাখার খুশিটা ম্লান হয়ে গিয়েছে কোচবিহারে নীতীশ প্রামাণিকের মত হাই প্রোফাইল কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হারে। নীতীশের হারটাকে রাজ্যের সবচেয়ে বড় অঘটন হিসেবে দেখছে বঙ্গ বিজেপি শিবির।
বিজেপি-কে সবচেয়ে হতাশ করেছে দুই বর্ধমানের ফল। গতবার বিজেপি পশ্চিম বর্ধমানের দুটি আসনেই জিতেছিল, এবার দুটিতেই হারতে হয়েছে বড় ব্যবধানে। বীরভূমে আবার হার নয়, ভোট কমেছে অনেকটা। বাঁকুড়া, ঝাড়গ্রাম, মেদিনীপুর হাতছাড়া হওয়ার বেদনাও রয়েছে। তবে বিজেপির কাছে সবচেয়ে হতাশা হল, তৃণমূলের থেকে একটা আসনও ছিনিয়ে নিতে না পারা।
তবে রাজনীতিতে অতীত ধরে বসে থাকলে হয় না। হতাশা ঝেরে ফেলে২০২৬ বিধানসভা ভোটকে পাখির চোখ করে এগোতে চাইছে বঙ্গ বিজেপি। আগামী মাসে চারটি বিধানসভা আসনের উপনির্বাচন নিয়ে কোমর বেঁধে নামছেন শুভেন্দু অধিকারী-রা। রায়গঞ্জ, বাগদা ও রানাঘাট দক্ষিণ বিজেপির দখলে আছে। এই তিনটি ধরে রেখে মানিকতলা নিয়ে ভাবছে বিজেপি। যদিও রাজ্য বিজেপি নেতারা বুঝতে পারছেন, কেন্দ্রে জোট সরকার থাকায় কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বাংলাকে আগের মত ততটা গুরুত্ব হয়তো দিতে পারবে না। মোদী, শাহ-রা আর আগের মত ভোটের আগে ঘনঘন ছুটে আসবেন কিনা সেই সংশয়ও থাকছে। এবার যা করার নিজেদেরকেই করতে হবে বলে মনে করছে বঙ্গ বিজেপি।
এবারের লোকসভা ভোটে বিজেপির সবচেয়ে বড় পজেটিভ হল-১) মোদী হাওয়া না থাকলেও কিছু আসনে নিজেদের সংগঠনের জোরে জয় এসেছে, ২) শুভেন্দু অধিকারীর গড়ে দুটি আসনেই (তমলুক, কাঁথি) জেতা গিয়েছে, ৩) কোচবিহার বাদ দিলে উত্তরবঙ্গের গড় ধরে রাখা গিয়েছে, ৪) পুরুলিয়া, বিষ্ণুপুরের মত কঠিন আসনে জয় এসেছে, ৪) মোদী হাওয়া ছাড়াই কলকাতার কিছু ওয়ার্ডে ভাল ফল হয়েছে, ৫) ভোটের সময় সাধারণ কর্মীরা পরিশ্রম করছেন।
সুকান্ত মজুমদার কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী হয়েছেন। তাই বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি পদে শুভেন্দু অধিকারীর আসা প্রায় নিশ্চিত। বিজেপি জানে এই করুণ অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে ২০২৬-র ভোটে বাংলায় পদ্ম ফোটাতে হলে একমাত্র শুভেন্দুই পারেন। ২০০৬ বিধানসভায় বামফ্রন্ট ২৩৫টি আসনে জয়ের পাঁচ বছর পর ক্ষমতায় এসেছিলেন মমতা বন্দ্য়োপাধ্যায়। মমতার সেই ঐতিহাসিক প্রত্যাবর্তনে সবচেয়ে বড় সেনাপতি ছিলেন শুভেন্দু। তবে বাংলায় এখন যেভাবে মমতা ঝড় চলছে, তাতে বিজেপি-র ঘুরে দাঁড়ানোর কাজটা 'মিশন ইমপসিবল' বলে মনে হচ্ছে এখন। যদিও বাংলায় ক্ষমতা দখল বরাবরই মিশন ইমপসিবল জায়গা থেকেই সম্ভব হয়েছে। ১৯৭৭-এ বামেরা, ২০১১ তৃণমূল। একটা সময় সেগুলোও মনে হয়েছিল মিশন ইমপসিবল।