পার্থ প্রতিম চন্দ্র: দেখতে দেখতে চলে এল দিল্লির ভোট। আগামী পাঁচ বছর দেশের রাজধানীতে রাজ করবে কারা তা ঠিক হতে চলেছে। আগামী বুধবার, ৫ ফেব্রুয়ারি দিল্লিতে বিধানসভা নির্বাচন। গত ১০-১২ বছর ধরে দিল্লি হল অরবিন্দ কেজরিওয়ালের গড়। বিধানসভা ভোট হলেই কেজরি ঝড়ে বিরোধীরা একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যান। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী অনেক চেষ্টা করলেও গত দশ বছরে দিল্লিতে বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপিকে আসন সংখ্যায় 'ডবল ডিজিট'-এ নিয়ে যেতে পারেননি। তবে এবার বিজেপির অনেক আশা। কারণ আবগারি দুর্নীতি মামলায় কেজরিওয়াল, মণীশ সিসোদিয়া, সত্যৈন্দ্র জৈন সহ আপের শীর্ষ নেতারা জেল খেটেছেন। বিজেপির দাবি, তাতে কেজরির স্বচ্ছ ভাবমূর্তি কালিমা লাগায়, ভোটাররা আর তার সঙ্গে থাকবে না।
কেজরিওয়ালের অবশ্য দাবি, তার বিরুদ্ধে ইডি, সিবিআইয়ের মত কেন্দ্রীয় সংস্থাকে কাজে লাগিয়ে বিজেপি নোংরা রাজনীতি করেছে। এবং বিজেপির এই অপপ্রচার ও অপচেষ্টায় আসলে তার দলের লাভই হবে। ক মাস আগে লোকসভায় আপের সঙ্গে জোট বেধে লড়া কংগ্রেস এবার দিল্লিতে কেজরিওয়ালের বিরুদ্ধে নজিরবিহীন আক্রমণের পথে নেমেছে। রাহুল গান্ধী কেজরিওয়ালকে মোদীর থেকে ধূর্ত ও দুর্নীতিগ্রস্থ বলে কটাক্ষ করেছেন। আসলে দিল্লিতে কংগ্রেসের ভোটব্য়াঙ্ককে থাবা বসিয়েই কেজরি রাজ করছেন। এবার কেজরিকে হারাতে তাই মরিয়া হাত শিবির। সব মিলিয়ে ত্রিমুখি লড়াইয়ে এবার দিল্লির ভোটের বাজার সরগরম।
দেখুন এবারের দিল্লির নির্বাচনে আটটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস-
১) কত জন ভোটার, কতগুলি আসন, কবে ভোট:
দিল্লিতে মোট ৭০টি বিধানসভা আসন আছে। ১ কোটি ৫৫ লক্ষ ২৪ হাজার ৮৫৮ জন তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করার সুযোগ পাবেন। ভোটারদের মধ্যে ৭১ লক্ষ ৭৩ হাজার মহিলা (৪৫ শতাংশ) ও ১২৬১ জন তৃতীয় লিঙ্গের। এবার দিল্লিতে প্রথমবার ভোট দেওয়ার সযোগ পাবেন (১৮-১৯ বছরের) ৫২ হাজার ৫৫৪ জন। আগামী ৫ ফেব্রুয়ারি, বুধবার এক দফায় দিল্লির সব করটি আসনে ভোটগ্রহণ হবে। ফলপ্রকাশ ৮ ফেব্রুয়ারি, শনিবার।
২) মূল লড়াইয়ে কারা:
ত্রিমুখি লড়াইয়ে মুখোমুখি রাজ্যের শাসক দল আম আদমি পার্টি, প্রধান বিরোধী দল বিজেপি ও রাজ্যের টানা ১৫ বছরের প্রাক্তন শাসক দল কংগ্রেস। দিল্লিতে ১৯৯৮ সাল থেকে টানা ১৫ বছর দিল্লিতে ক্ষমতায় থাকা কংগ্রেস গত দুটি বিধানসভা ভোটে কোনও আসন পায়নি। বিধানসভায় কংগ্রেসের ভোট ৫ শতাংশে নেমে গিয়েছে। দিল্লির ২০-২৫টি আসন ছাড়া, বাকি ৪৫-৫০টি আসনে সরাসরি আপ ও বিজেপির লড়াই। ৩-৪টি আসনে আপ বনাম কংগ্রেস, ১-২টি আসনে সরাসরি বিজেপি বনাম কংগ্রেস হতে পারে। ১০-১৫টি আসনে কংগ্রেস তাদের পুরনো ভোটব্যাঙ্ক ফিরে পেয়ে ভাল লড়াই দিতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। কিন্তু রাজ্যের ৭০-৭৫ শতাংশ আসনেই মূল লড়াইটা আপ ও বিজেপির মধ্যে হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
৩) হেভিওয়েট প্রার্থীরা:
আম আদমি পার্টির- অরবিন্দ কেজরিওয়াল (নয়া দিল্লি), আতিশি মার্লেনা (কালকাজি), মণীশ সোসদিয়া (জঙপুরা), গোপাল রাই (বাবরপুর), সৌরভ ভরদ্বাজ (গ্রেটার কৈলাশ), অবধ ওঝা (পরপতগঞ্জ), সত্যৈন্দ্র জৈন ( শাকুর বস্তি)।
বিজেপির হেভিওয়েটরা- পরবেশ ভর্মা (নয়া দিল্লি, কেজরিওয়ালের বিরুদ্ধে), রমেশ বিধুরি (কালকাজি, মুখ্যমন্ত্রী আতিশি মার্লেনার বিরুদ্ধে), কপিল মিশ্র (কারওয়াল নগর), অমরিন্দর সিং লাভলি (গান্ধীনগর), কৈলাশ গেহলট (বিজওয়াসন)।
কংগ্রেসের হেভিওয়েটরা- সন্দীপ দীক্ষিত (নয়া দিল্লি, কেজরিওয়ালের বিরুদ্ধে), আলকা আম্বা (কালকাজি, মুখ্যমন্ত্রী আতিশি মার্লেনার বিরুদ্ধে)
৪) নজরে যে সব আসন:
ক) নয়া দিল্লি, খ) কালকাজি, গ) গান্ধীনগর, ঘ) কালাম, ঙ) জঙপুরা, চ) পারপতগঞ্জ, ছ) কারওয়াল নগর।
৫) মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থীরা:
ঝাড়ু শিবির: আপ জিতলে কেজরিওয়াল মুখ্যমন্ত্রী হবেন, মণীশ সিসোদিয়া হবেন উপমুখ্যমন্ত্রী।
পদ্ম শিবির- গত দুবারের মত বিজেপি এবার মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী ঘোষণা করেনি।
হাত শিবির: পিছিয়ে থেকে নির্বাচন শুরু করা কংগ্রেস মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী ঘোষণা করার মত জায়গায় নেই।
৬) তিন দলের প্রধান প্রতিশ্রুতিগুলি:
মহিলা ভাতা:
আপ- মাসে ২২০০ টাকা। বিজেপি: ২৫০০ টাকা। কংগ্রেস: ২৫০০ টাকা।
আপের ঘোষণা: ক) প্রবীণদের বিনামূল্যে চিকিৎসা পরিষেবা, খ) পুরোহিত ভাতায় মাসে ১৮ হাজার টাকা, গ) বিনামূল্যে জল ও বিদ্যুত, ঘ) অটো চালকদের মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার জন্য ১ লক্ষ টাকার আর্থিক সাহায্য, পোশাক ভাতা আড়াই হাজার ও জীবন বীমা।
বিজেপির ঘোষণা: ক) গরীব মহিলাদের ৫০০ টাকায় গ্যাস সিলন্ডার ও দিওয়ালি-হোলিতে একটি করে বিনামূল্যে গ্যাস সিলিন্ডার। খ) অন্ত:স্বত্ত্বা মহিলাদের ২১ হাজার টাকার আর্থিক সাহায্য, গ) ৫ লক্ষ টাকার স্বাস্থ্য বীমা, ঘ) প্রবীণ নাগরিকদের মাসে আড়াই হাজার টাকার পেনশন, ঙ) অটল ক্যান্টিনের মাধ্যমে গরীব মানুষদের ৫ টাকায় খাবার দেওয়া, চ) কেজরিওয়াল জমানায় হওয়া সব দুর্নীতির তদন্ত করা, ছ) তিন বছরের মধ্য়ে যমুনা নদীকে পুরোপুরি পরিষ্কার করা, জ) প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় বসা পড়ুয়াদের ১৫ হাজার টাকার আর্থিক সাহায্য, ঝ) অটো চালকদের জন্য ১০ লক্ষ টাকার জীবন বীমা, ৫ লক্ষ টাকার দুর্ঘটনা বীমা।
কংগ্রেসের ঘোষণা: ১) প্রবীণ নাগরিকদের মাসে ৫ হাজার টাকার পেনশন, ২) বিনামূল্যে রেশন। ৩) বিনামূল্যে ৩০০ ইউনিট বিদ্যুত, ৪) ২৫ লক্ষ টাকার স্বাস্থ্য বিমা, ৫) শিক্ষিত বেকারদের জন্য মাসে সাড়ে ৮ হাজার টাকার ভাতা, ৬) ৫০০ টাকায় রান্নার গ্যাস সিলিন্ডার, ৭) স্কুল পড়ুয়াদের বিনামূল্যে বাস ভ্রমণ, ৮) ২৪x৭ পানীয় জলের ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করা, ৯) বায়ু দূষণহীন দিল্লি নিশ্চিত করা, ১০) দুর্নীতিমুক্ত স্বচ্ছ প্রশাসন।
৭) প্রচারে এগিয়ে কারা:
নরেন্দ্র মোদী থেকে অমিত শাহ, বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, দাপুটে নেতাদের প্রচারে নামিয়ে দলের পালে হাওয়া আনার চেষ্টা করেছে বিজেপি। কংগ্রেসের হয়ে প্রচার করেছেন রাহুল গান্ধী। তবু অনেকটা আগে থেকে প্রচারে নামা অরবিন্দ কেজরিওয়ালের দলের প্রচারে ঝাঁঝ বেশী বলেই অনেকে বলছেন। যদিও নরেন্দ্র মোদীর সভায় বেশ ভিড় হয়েছে, বলে বিজেপির আশা এবার তারাই ক্ষমতায় আসবে।
৮) যে তিন প্রশ্নের জবাবের দিকে তাকিয়ে সবাই:
ক) আপকে নিয়ে-কেজরিওয়াল বারবার তিনবার বিধানসভা ভোটে মোদীকে ধরাশায়ী করতে পারবেন কি? জেল খেটে জামিনে মুক্ত কেজরিওয়ালকে নিয়ে দিল্লির ভোটারদের মধ্যে নিজের ক্যারিশ্মা বজায় রাখতে পারবেন?
খ) বিজেপিকে নিয়ে- গোটা দেশে ঝড় তুললেও দিল্লিতে গত ২৭ বছর ধরে ক্ষমতার ধারেকাছে নেই বিজেপি। দেশে টানা তিনবার রাজ করলেও নরেন্দ্র মোদী ম্যাজিক কেজরি গড়ে কাজ করেন না। কিন্তু এবার হবে কি?
গ) কংগ্রেসকে নিয়ে-গত তিনটি লোকসভা আর দুটি লোকসভা ভোটে দিল্লিতে কোনও আসন পাইনি কংগ্রেস। যে রাজ্যে টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় ছিল কংগ্রেস, সেখানে কেজরিওয়ালের উত্থানের পর দিল্লির নির্বাচনের আকাশে হাত একেবারে অস্ত গিয়েছে। এবার কংগ্রেস খাতা খুলতে পারবে কি? কেজরিওয়ালকে সরকার গড়তে হলে শেষ অবধি কংগ্রেসে কাছে সাহায্য চাইতে হবে কি?