Mangal Sobhajatra (Photo Credit; X

প্রাচীন লোককথা বলে যে জাতির রাজা নেই, সে জাতির ইতিহাস নেই। ভারত একটি প্রাচীন সভ্যতার দেশ, সব জাতিরই বহু পুরনো রাজা ও রাজত্ব রয়েছে, অথচ বাঙ্গালীর ইতিহাস শুরুই হয় নেতাজি ও রবীন্দ্রনাথ থেকে, বাঙ্গালীর প্রাচীন গৌরব শশাঙ্ক, বিজয় সিংহ, গঙ্গারিদ্ধি, চন্দ্রকেতুগড় ইত্যাদি আজ সবই বিস্মৃত। তাই ঘটা করে বাঙালি পয়লা বৈশাখ পালন করলেও এখনও বাঙালি জ্ঞাত নয় যে বঙ্গাব্দের সূচনা কার হাত ধরে।

"হাজার বছরের বাঙ্গালী জাতি"র অসার তত্ত্বের পথের কাঁটা মহারাজা শশাঙ্ক। বখতিয়ার খিলজির আক্রমণ থেকেই নাকি বাঙ্গালী জাতির সূচনা- এই মিথ্যা ইতিহাস কে খণ্ডন করতে জানতে হবে  প্রায় দেড় হাজার বছরের প্রাচীন রাজা শশাঙ্কের পুনঃপ্রতিষ্ঠার ইতিহাস। ষষ্ঠ শতক ধরে এগিয়ে চললে গৌড়াধিপতি মহারাজা নরেন্দ্র আদিত্য শশাঙ্ক, গৌড়েশ্বর পরম ভট্টারক ধর্মপাল, গৌড়েশ্বর পরম ভট্টারক দেবপাল, মহারাজা বল্লাল সেন, মহারাজা লক্ষণ সেন, রাজা পৃথুদেব রায়, রাজা চন্দ্রনাথ, উজানীপতি বিক্রমজিত ঘোষ, পঞ্চ গৌড়েশ্বর গণেশনারায়ণ ভাদুড়ী, রায়বাঘিনী মহারাণী ভবশংকরী, মহারাজ বীর হাম্বীর মল্লদেব, রায়শ্রেষ্ঠ মহারাজা প্রতাপাদিত্য, চাঁদ রায় –কেদার রায়, কর্ণগড়েশ্বরী মহারাণী শিরোমণি প্রভৃতির বীরত্বপূর্ণ অসামান্য কাহিনীগুলি যদি তুলে ধরা যায়, তবেই বাঙ্গালী উপলব্ধি করতে পারবে কোন বীর বংশে তারা জাত।

মহারাজা শশাঙ্কের জীবন, যুদ্ধ বিগ্রহ, রাজ্য জয়, খন্ডে খন্ডে বিভক্ত বঙ্গদেশকে প্রথম এক সূত্রে বেঁধে এক রাজ্য বানানো, দীঘি খনন, চীনের চক্রান্ত হনন, বিশ্বের প্রথম সংবিধান গৌড় তন্ত্র প্রণয়ন এই সব কিছু নিয়েই শশাঙ্কের জীবন কাহিনী। কিন্তু শশাঙ্ক চরিত্র কে অগ্রাধিকার দেওয়ার মূল কারণ তিনি বাঙ্গালীয়ানার প্রবর্তক। আজকের আধুনিক বাঙ্গালী জাতির আবির্ভাব তাঁর হাত ধরেই। এর পরবর্তীকালে শ্রীচৈতন্যদেব ও রবীন্দ্রনাথ এই বাঙ্গালিয়ানার ধারাকে পুষ্ট করেছেন। বৌদ্ধ ধর্মাবেগে আবদ্ধ বাঙ্গালীকে তিনি আবার সনাতনীধারায় ফিরিয়ে এনেছেন। তাঁর হাত ধরেই বাঙালি পেয়েছে নিজস্ব কাল পঞ্জিকা বঙ্গাব্দ। বাঙ্গালীর নিজস্ব যুগাব্দ।

গৌড়ীয় জাতির জনক, জাতি সংগঠক এবং গৌড় সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা গৌড়াধিপতি শশাঙ্কদেব, যাঁর রাজ্যাভিষেকের সঙ্গেই ক্রমান্বয়ে একাধিক বিজয়ের ফলে সমগ্র বিশ্বের বুকে গৌড়ীয় জাতি এক মহাশক্তিধর নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছিল।

পৃথিবীর যে কোনো জাতির উত্থানের ইতিহাসের সরল রূপরেখা হলো একজন পরাক্রমশালী যোদ্ধার নেতৃত্বের বিভিন্ন ক্ষুদ্র ভূখণ্ড জনপদ একত্রিত হয়ে এক ধর্ম্ম, এক ভাষা, এক সংস্কৃতির বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে এই বৃহৎ জাতীয় রাজ্য নির্মাণ করে । সেই ঐক্যচেতনার অন্তর্গত প্রতিটি ব্যক্তি, পরিবার নিয়ে নির্ম্মিত হয় জাতি । আমাদের বাঙ্গালী জাতির ক্ষেত্রে এই নেতৃত্বের দার্ঢ্য অর্জন করেছিলেন মহারাজাধিরাজ শশাঙ্কদেব । তাঁর সফল নেতৃত্বে বরেন্দ্র-রাঢ়-বঙ্গ সম্মিলিত সমগ্র ভূখণ্ড একক গৌড়ীয় নিয়ন্ত্রণের অন্তর্ভুক্ত হয় । গৌড়াধিপ শশাঙ্কের শাসনাধীন গৌড়ীয় জাতির জাতীয় ঐক্যের মাধ্যম ছিল এক গৌড়ীয় ভাষা, তাঁর নামাঙ্কিত গৌড়ীয় স্বর্ণমুদ্রা এবং গৌড়ীয় সংস্কৃতি - গৌড়ীয় রাগসঙ্গীত, গৌড়ীয় নৃত্য, গৌড়ীয় রীতি স্থাপত্য-ভাস্কর্য ইত্যাদি । ইতিহাস বলে বঙ্গাধিপতি শশাঙ্কদেব বাঙ্গালী জাতির নিজস্ব দিনপঞ্জি “বঙ্গাব্দ” নির্মাণ করেছেন । সূর্য্যসিদ্ধান্ত অনুসারে তাঁর রাজ্যাভিষেকের দিবস (৫৯৩ খ্রিষ্টাব্দ) হতেই বঙ্গাব্দের সূচনা, যা আজও আমাদের দৈনিক কালনির্ধারণের মাধ্যম ।

সম্রাট শশাঙ্কের শাসনে বাঙ্গালী জাতির ধ্রুপদী নৃত্যরীতি ‘গৌড়ীয় নৃত্য’ রাজকীয় পৃষ্ঠপোষনা লাভ করে । শৈবসাংস্কৃতিক ধারায় প্রভাবিত এই নৃত্য প্রাচীন বঙ্গীয় কবিদের দ্বারা গৌড়ীয় সংগীতের রাগ ও তাল অনুসারে রচিত ও সুরাপিত গানের মাধ্যমে ধর্মীয় গল্প প্রকাশ করেছিল । তাঁর শাসনকালে হিউয়েন সাং, গৌড় ভ্রমণপূর্বক নিজ বৃত্তান্তে গৌড়ীয়দের মধ্যে ‘মুখোশ পরিহিত নৃত্য’ধারার উল্লেখ করেছেন যা ‘গম্ভীর নৃত্য নামে সুখ্যাত।

গৌড়ীয় সঙ্গীতধারার অন্যতম নিদর্শন হলো ‘কীর্ত্তন, যা বহু প্রাচীনকাল থেকে আমাদের বাঙ্গলা ভাষার কাব্যিক ঐতিহ্য, পারম্পৰ্য্য এবং মাধুর্য্য সংরক্ষণ করে আসছে । গৌড়ীয় কীর্ত্তন সঙ্গীতরীতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ এক বিশেষ বাদ্যযন্ত্র - ‘শ্রীখোল’ । গৌড়ীয় নগরকীর্ত্তনের সূচনালগ্ন থেকে খোল পরিব্রাজকদের অবিচ্ছিন্ন সঙ্গী থেকেছে ।

শশাঙ্কের ইতিহাস পাঠ বাঙালিকে নিজের ইতিহাসকে সচেতন করবে তেমনি ভারতের অন্যান্য জাতি যেমন নিজেদের রাজকাহিনী শুনে গর্ব করে, তেমনি বাঙ্গালীও তা করতে পারবে। যে জাতি যত প্রাচীন তাদের রাজাও তত প্রাচীন। তাই এপার বাংলা হোক বা ওপার বাংলা গৌড়াধিপতি শশাঙ্কদেবের বংশধর এই বাঙ্গালী জাতির ধর্ম্ম-সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ এই ‘নববর্ষ। নববর্ষের এই "মঙ্গল শোভাযাত্রা" আসলে বাঙ্গালীয়ানার প্রবর্তক মহারাজা শশাঙ্ক কে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাতে।

তাই প্রতি বছর বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে আয়োজিত হয় মঙ্গলযাত্রা।