
বাংলা ক্যালেন্ডারের বারোটি মাসের শেষ মাস চৈত্র, যার শেষ সপ্তাহ জুড়েই বাংলার নানা প্রান্তে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক আবহ ঘনীভূত হয়। এই সময়টাই একদিকে যেমন বাংলা নববর্ষের প্রস্তুতির শেষ অধ্যায়, তেমনি অন্যদিকে এটি মহাদেব দর্শনের এক বিশেষ শুভ সময় হিসেবেও বিবেচিত।
হিন্দু ধর্ম মতে, চৈত্র মাসের অন্তিম সপ্তাহে—বিশেষত চৈত্র সংক্রান্তির প্রাক্কালে—শিব দর্শন, উপাসনা ও পুজো বিশেষ ফলদায়ক বলে মানা হয়। এই সময়ে শিবমন্দিরে ভক্তদের উপচে পড়া ভিড় দেখা যায়। অনেকেই গঙ্গা বা অন্য পবিত্র নদীতে স্নান করে মহাদেবের চরণে বিলি দেন জল, বেলপাতা, ধুতুরা ও দুধ। ধারণা করা হয়, এই তিথিতে মহাদেবের দর্শন ও উপাসনা করলে পাপমোচন হয় ও জীবনে সুখ-সমৃদ্ধি আসে।
চৈত্রের শেষ সপ্তাহে পড়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তিথি—যেমন পঞ্চমী, অষ্টমী, একাদশী বা ত্রয়োদশী—যেগুলো শিব উপাসনার জন্য আদর্শ। বিশেষ করে ‘ত্রয়োদশী তিথি’, যা অনেক সময় প্রায়-প্রদোষের মতো হয়ে দাঁড়ায়, তা শিব আরাধনার জন্য এক অতীব শুভ মুহূর্ত।
এই সময়ে গ্রামের মেলা, বারুণী যাত্রা, আর ‘চৈত্র সংক্রান্তি মেলা’র সাথেও জড়িয়ে থাকে শিবের উপাসনা। অনেক জায়গায় দেখা যায়, মহাদেবের ভাসান উৎসব কিংবা গাজনের প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায় এই সপ্তাহেই।
পশ্চিমবঙ্গের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ও প্রসিদ্ধ শিবমন্দির সম্পর্কে, যেখানে গাজন ও নীল ষষ্ঠী উপলক্ষে হয়ে থাকে বিশেষ পূজা ও আচার-অনুষ্ঠান। চলুন জেনে নিই কোন কোন মন্দিরগুলি এই সময়ে দর্শনের জন্য আদর্শ।
১. তারকেশ্বর মন্দির, হুগলি
পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম প্রাচীন তীর্থ হল তারকেশ্বর। হুগলি জেলার এই মন্দিরে সারা বছরই ভক্ত সমাগম লেগে থাকে, তবে গাজন উপলক্ষে এখানে তৈরি হয় এক আলাদা আবহ। মন্দির প্রাঙ্গণে নানান লোকাচার পালিত হয় — যেমন সন্ন্যাসী সাজা, ধুনুচি নাচ, ঢাক বাজানো ইত্যাদি। শিবলিঙ্গটি এখানে অত্যন্ত জাগ্রত বলে মানা হয়, এবং প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী, এখানে পূজা দিলে মনস্কামনা পূর্ণ হয়।
২. বৌদ্ধেশ্বর মন্দির, নদিয়া
নদিয়া জেলার অন্তর্গত এই বিখ্যাত শিবমন্দিরে প্রতি বছর গাজনের সময়ে পালিত হয় “মহা গাজন”। এখানকার গাজন উৎসব কেবল ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, বরং এটি এক বৃহৎ লোকউৎসবে পরিণত হয়েছে। সন্ন্যাসীদের রঙিন পোশাক, নাচ-গান, শোভাযাত্রা মন্দিরের বিশেষ আকর্ষণ হলো শিবের অলৌকিক রূপে উপস্থাপনা এবং রাত্রিকালীন ভক্তি সংগীত।
৩. বর্ধমানের ১০৮ শিবমন্দির
বর্ধমান রাজবাড়ির পাশে অবস্থিত এই মন্দির কমপ্লেক্সটি একটি অসাধারণ স্থাপত্য কীর্তি। ১০৮টি শিবলিঙ্গ এখানে সারি দিয়ে স্থাপন করা হয়েছে, যা একত্রে পূজিত হয় গাজনের দিন। এই মন্দির চত্বর জুড়ে গাজনের সময়ে থাকে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য — ভোর থেকে রাত অবধি পূজা, আরতি, শোভাযাত্রা আর ধর্মীয় আচার চলতেই থাকে। এটি শুধুমাত্র এক ধর্মীয় স্থান নয়, বরং ইতিহাস ও ঐতিহ্যের এক জাগ্রত নিদর্শন।
৪. মোটা শিব, বর্ধমান শহর
বর্ধমান শহরের অন্যতম প্রধান শিবমন্দির ‘মোটা শিব’ নামে পরিচিত। বিশালাকৃতির শিবলিঙ্গের জন্যই এই নাম। গাজনের সময় এই মন্দিরে ভক্ত ভিড় জমান। বিশেষ করে যারা কোনো মানত করেছেন বা সারা বছর উপবাস করেছেন, তারা এখানে এসে বিশেষ পূজা দেন। ভক্তদের বিশ্বাস, মোটা শিব সব অনুরোধ মন দিয়ে শোনেন এবং সঠিক সময়ে ফলও দেন।
৫. জয়রামবাটি শিবমন্দির, বাঁকুড়া
মা সারদার জন্মভূমি জয়রামবাটির আশেপাশে অবস্থিত এই শিবমন্দিরেও গাজনের সময় ভক্তদের ভিড় লেগে থাকে। এই মন্দিরের পরিবেশ অত্যন্ত শান্ত এবং পবিত্র। অনেকেই এখানে ধ্যান ও নির্জনতা খুঁজে পান। চৈত্রের শেষ দিনে এখানে একটি বিশেষ মহাপূজার আয়োজন করা হয়।
৬. কালীঘাট শিবমন্দির, কলকাতা
যদিও এই মন্দির মূলত কালীমন্দির হিসেবে পরিচিত, তবে শিবও এখানে পূজিত হন কালীঘাটের নিকটবর্তী শম্ভুনাথ মন্দিরে। নীল ষষ্ঠীর দিন এখানে নারী ভক্তদের উপস্থিতি নজরকাড়া। বহু নারী নীল পুজো দেন, উপবাস রাখেন ও শিব-দুর্গার মঙ্গল কামনায় প্রার্থনা করেন।
৭. কাশী বিশ্বনাথ মন্দির, বারাণসী
পশ্চিমবঙ্গের বাইরে হলেও গাজনের দিনে বহু শিবভক্ত বারাণসীর কাশী বিশ্বনাথ দর্শনের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। এখানে শিব আরাধনার মাহাত্ম্য অতুলনীয়। কাশীতে গাজনের দিন মহাপূজা, রুদ্রাভিষেক ও নানা আচার অনুসরণ করা হয়, যা ভক্তদের অন্তরাত্মায় গভীর প্রভাব ফেলে।
এই বিশেষ দিনে আপনি যদি শিব দর্শনের পরিকল্পনা করেন, তবে এই মন্দিরগুলির যেকোনো একটিতে ঘুরে আসতে পারেন। আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতার পাশাপাশি আপনি অনুভব করবেন লোকজ উৎসবের প্রাণ ও রং।