বর্তমানে কলকাতার প্রাচীন দুর্গাপূজা বলতে যেটা সামনে উঠে আসে, সেটা হল - বড়িশার সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের দুর্গাপূজা। যেটি, ৪০০ বছরের পুরানো বলা হয়। তবে বাংলার বনেদি বাড়ির পুজো মানেই দুর্গাপুজো নয়, অনেক বনেদি বাড়ির কালীপুজোও সমান জনপ্রিয়। যেমন ৪০০ বছরের পুরনো প্রামাণিক বাড়ির কালীপুজো।
জানা যায়, বর্ধমানের ছেলে চন্দ্রশেখর প্রামাণিক কর্মের টানে এসেছিলেন কলকাতায়। কাঁসারি পাড়ায় তিনি ঘর বাঁধলেন। পরবর্তীকালে তাঁর সাতটি পরিবার এক সঙ্গে মিলে পরিচিত হলেন ‘সাধুকা প্রামাণিক’ নামে বা সাতঘর প্রামাণিক নামে। আর সেই থেকেই শুরু হয় তাদের কুলদেবী কালীর আরাধনা। লোকে বলে, এই পাড়ায় এককালে কালীপুজোটা বারোয়ারী ছিল। কোনো কারণে এই বারোয়ারী কালীপুজো বন্ধ হবার উপক্রম হলে, এই "সাত ঘর প্রামাণিক" পরিবার সানন্দে কালী মাতৃকার পুজোর ভার গ্রহণ করেন। সেই থেকেই এই প্রামাণিক বাড়ির কালীপুজো কলকাতার প্রাচীন ও বনেদি পরিবারের এক অন্যতম পুজো হয়ে ওঠে। বলা বাহুল্য, মা কালীও এই প্রামাণিক পরিবারের প্রতিটি সদস্যকে বুকে করে আগলে রাখেন আজও। এ বাড়ির মা যেন সাক্ষাৎ এক 'বাচ্চা মেয়ে'। তাই হয়তো আজও গভীর রাতে ঠাকুর দালানে কান পাতলে নাকি শুনতে পাওয়া যায় অলৌকিক নূপুরের শব্দ!
এখানকার বিশেষ রীতি হল, দেবীকে প্রথমে ডাকের সাজে সাজিয়ে রাত গভীর হলে সোনার-রুপোর গয়না দিয়ে সাজানো হয়।পরিবারের সদস্যরা সায়াহ্নে সিদ্ধি গ্রহণ করেন। নৈবেদ্যের জন্য পুরোহিত প্রদান করেন কারণবারি।পুজোর সন্ধ্যায় ১০৮টি প্রদীপ জ্বালানো হয়।
পুজোর আচারেও রয়েছে বিশেষত্ব। দেবীর অর্ঘ্য তৈরি হয় ১০৮টি দুব্বো ঘাস আর ১০০টি ধান এক সঙ্গে একটি কাপড়ে বেঁধে।চাল, কলা, ফলমূল-সহ মোট ১৬-১৭ রকমের নৈবেদ্যে সাজানো হয় মায়ের ভোগ।লুচি, পাঁচ রকমের ভাজা, সন্দেশ এবং নতুন গুড়ের ভোগ নিবেদন করা হয় দেবীর চরণে।আরতির সময় ১০৮টি মাটির প্রদীপ এক সঙ্গে জ্বলে ওঠে, আলোয় ভরে ওঠে ঠাকুরদালান।কালের নিয়মে অনেক কিছুই বদলেছে। এক সময় পুজোয় ধুনো পোড়ানো আর দণ্ডী কাটার রীতি ছিল, তা এখনও চালু রয়েছে। তবে যে রীতিতে ছেদ পড়েছে, তা হলো পশুবলি। পশুবলি চিরতরে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে এই বাড়িতে।বহু বছর আগে মায়ের বিসর্জনও ছিল দেখার মতো। সে কালে দেবীকে কাঁধে করে নিয়ে যেতেন প্রায় পঞ্চাশ জন লাঠিয়াল। সেই জাঁকজমক হয়তো আজ আর নেই, তবে ভক্তি আর বিশ্বাসে এতটুকুও ভাঁটা পড়েনি।
View this post on Instagram
মধ্য কলকাতার প্রামাণিক বাড়ির কালীপুজো দেখতে যাবেন কী ভাবে?
তারক প্রামাণিক রোড। মধ্য কলকাতার গিরিশ পার্ক মেট্রো স্টেশন সংলগ্ন সিমলা ব্যায়াম সমিতির দিকে যাবার রাস্তাটার আগের নাম ছিল কাঁসারি পাড়া। মূলত এখানে কাঁসা - পিতল - ধাতুর ব্যবসায়ীদের আস্তনা ছিল। এই ব্যবসায়ীরাই "কংসবণিক" নামে ইতিহাসে পরিচিত। সেই থেকেই জায়গাটার নাম ছিল কাঁসারি পাড়া। পরে নাম হয় তারক প্রামাণিক রোড। এখানে গেলেই দেখা মিলবে ৪০০ বছরের পুরানো পুজোর।