ছোটবেলায় ভূতের গল্প, ভূতের সিনেমা খুব আজগুবি ব্যপার মনে হলেও, একটু বড় হতে বুঝেছিলাম আসলে সবটাই আজগুবি বা অদ্ভুতুড়ে নয়। কিছু কিছু লেখক ও পরিচালক ভূতেদের গল্পপকথার মধ্য দিয়ে মানুষের জীবনের কথাই তুলে ধরেন। কৌশিক হাফিজী পরিচালিত সম্প্রতি ‘ইইচই’-তে প্রকাশ পাওয়া ‘ভূততেরিকি’ (Bhootteriki) ওয়েব সিরিজটিতেও মানুষের জীবনের নানা দ্বন্দ্বের বিষয় ফুটে উঠেছে। পরিচালক অতিপ্রাকৃত চরিত্রগুলোর মধ্য দিয়ে খুব সূক্ষ্মভাবে মধ্যবিত্ব মানুষের জীবনের কামনা-বাসনা ফুটিয়ে তুলেছেন। সিরিজটিতে জীবনের দ্বন্দ্ব এবং কঠিন বাস্তবতার হৃদয়স্পর্শী মুহূর্তের মিশ্রণ ঘটেছে। আমাদের সমাজে নামের পিছনেও যে রাজনীতি রয়েছে সে বিষয়টিও পরিচালক মজার ছলেই ফুটিয়ে তুলেছেন।

বহু মানুষ আছেন যারা সমপ্রেম বা সমকামীদের মেলামেশা খুব ঘেন্নার চোখে দেখেন। আমরা অনেক হয়তো দেখে থাকবো, আয়ুষ্মান খুরানা অভিনীত 'শুভ মঙ্গল জাদা সাবধান' সিনেমাটিতে দুজন জৈবিক পুরুষের চুমু খাওয়ার দৃশ্যে দেখানো হয় ঘেন্নায় বমি করে ফেলছেন এক হিরোর বাবা, এই দৃশ্যটিতে সিনেমা হলে হাসির রোল বয়ে গেলেও সমাজে বহু মানুষ আছেন যারা সমপ্রেম তীব্র ঘৃণার চোখেই দেখেন। ‘ভূততেরিকি’-তে একজন জৈবিক নারীর ভিতরে পুরুষ সত্ত্বা ও একজন জৈবিক পুরুষের ভিতরে নারী সত্ত্বার একে অপরের প্রতি যে আকর্ষণ তা দারুণ একটি ফ্রেমের ভিতর দিয়ে চুমুর দৃশ্যের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

সিরিজটির কেন্দ্রীয় চরিত্রে রয়েছেন প্রতিভাবান অভিনেতা আভেরি সিংহ রায়, দীপান্বিতা সরকার, রাত্রি চট্টোপাধ্যায়, ঐশ্বর্য সেন, দুর্বার শর্মা, শৌনক কুণ্ডু ও দেবরাজ ভট্টাচার্য। মুখ্য অভিনেতাদের পাশাপাশি পাশ্ব চরিত্রগুলোর দক্ষ ও সাবলীল অভিনয় নজরকাড়ার মতো। মন ছুঁয়ে যাওয়া সব আবহ সঙ্গীত করেছেন উজান চট্টোপাধ্যায়। অনির্বাণ ভট্টাচার্যের লেখা ভূতেদের কৌতুক মেশানো পার্টির গানের কথাগুলো যেমন, ‘ওরা তক্কে তক্কে থাকে সুযোগ পেলেই বলে খেলা হবে…’ আমার তো বেশ মজার লেগেছে।

সিরিজটির পরিচালক কৌশিক হাফিজী বলেন, “ভূততেরিকি যেন মানুষ সহজভাবে নেন, আমাদের সামাজিক জীবন, রাজনৈতিক জীবন এবং মনস্তত্বতে যে বিষয়গুলো অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত সেগুলো আমি সিরিজটিতে কিছুটা ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছি। সিরিজটিতে আক্ষরিক অর্থে মানুষেরই গল্প বলা হয়েছে। কল্পনা জগতের ভূতেদের গল্প মানুষের মধ্য দিয়ে বলা বা মানুষের গল্প ভূতেরদের দিয়ে বলা, দুটো বিষয়ই সিরিজটিতে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছি। চরিত্রগুলো স্ক্রিনে ফুটিয়ে তুলতেও খুব একটা বেগ পেতে হয়নি কারণ আমরা খুব ভালো একটা টিমের সঙ্গে কাজ করেছি, এবং মাথার উপর অনির্বাণদা ছিল, অনির্বাণদাই সব ঝড়ঝাপটা সামলে নিয়েছে।”

পরিচালক আরও বলেন, “আমার যে গ্রামে জন্ম ও বেড়েওঠা সে সমাজে আমার পরিচালক হওয়ার ইচ্ছেটা প্রকাশ করাও আসলে লোক হাসাহাসির মতো ব্যপার ছিল। তবে, আমার মা বলতেন, ‘যে ধায় সে পায়’ আমি মায়ের এই কথা পাথেয় করে জীবনে এগিয়ে চলেছি। আশা করি আমার পরিচালিত প্রথম ওয়েব সিরিজ ‘ভূততেরিকি’ মানুষের ভালো লাগবে।”

ভূততেরিকি সিরিজের ভূতগুলো কেবল অতিপ্রাকৃত সত্ত্বা নয়, বরং মানুষের চরিত্রের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের প্রকাশ হিসেবে উপস্থিত হয়েছে। সিরিজটির সামান্য কিছু দোষত্রুটি সত্ত্বেও প্রতিটি চরিত্রের গভীরতা এবং গল্পের বুনন দর্শকদের মনে এক অসাধারণ অভিজ্ঞতার সঞ্চার করবে।