পার্থ প্রতিম চন্দ্র: পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির (West Bengal BJP) প্রধান হিসেবে নির্বাচিত হলেন রাজ্যসভার সাংসদ শমীক ভট্টাচার্য (Samik Bhattacharya)। বসিরহাট দক্ষিণের প্রাক্তন বিধায়ক শমীকের (Bengal BJP President Samik Bhattacharya) নেতৃত্বেই ২০২৬ বঙ্গ বিধানসভায় লড়বে গেরুয়া শিবির। ২০১৯ লোকসভা ও ২০২১ বিধানসভা-পরপর দুটি নির্বাচনে হেরে একটা সময় দলে কোণঠাসা হয়ে গিয়েছিলেন শমীক। তাঁকে ছাপিয়ে তৃণমূল থেকে আসা অনেক নেতাই বঙ্গ বিজেপিতে সামনের সারিতে চলে এসেছিলেন। কিন্তু কোণঠাসা হয়েও কখনও দলকে অস্বস্তিতে না ফেলা, লড়াই চালিয়ে যাওয়া শমীককে কিছুটা অপ্রত্যাশিতভাবেই বঙ্গ বিজেপির ব্যাটন ধরিয়ে দিলেন অমিত শাহ-জেপি নাড্ডা-রা। গত বছর শমীককে রাজ্যসভায় পাঠিয়ে পুরস্কার দিয়েছিল বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। রাজ্যসভায় ভাল পারফরম্যান্স করে এবং বঙ্গ বিজেপির সবস্তরের নেতাদের মধ্যে জনপ্রিয়তায় বাকিদের টেক্কা দিয়ে রাজ্য সভাপতির হটসিটে বসছেন শমীক।
বঙ্গ বিজেপির ১৪তম সভাপতি শমীক ভট্টাচার্য
বঙ্গ বিজেপির ১৪তম রাজ্য সভাপতি হলেন শমীক। এর আগে পশ্চিমবঙ্গ বিজেপিতে মোট ৯ জন রাজ্য সভাপতির পদে বসেছেন। তাঁদের মধ্যে দু দফায় রাজ্য সভাপতি হন বিষ্ণুকান্ত শাস্ত্রী (১৯৮২-৮৬, ১৯৯৫-৯৭), তপন সিকদার (১৯৯১-৯৫, ১৯৯৭-৯৯) ও সুকুমার বন্দোপাধ্যায় (১৯৮৬-৯১)। একবার করে বঙ্গ বিজেপির রাজ্য সভাপতি হয়েছেন হরিপদ ভারতী (১৯৮০-৮২),অসীম ঘোষ (১৯৯৯-২০০২), সত্যব্রত মুখোপাধ্যায় (২০০৮-০৯), রাহুল সিনহা (২০০৯-১৫), দিলীপ ঘোষ (২০১৫-২১), সুকান্ত মজুমদার (২০২১-২৫)। এবার সেই আসনে বসছেন শমীক ভট্টাচার্য । আরও পড়ুন-কোন অঙ্কে বিজেপির রাজ্য সভাপতি পদে বসছেন শমীক ভট্টাচার্য, বার্তা কি শুভেন্দুদের!
বাংলায় বিজেপির রাজ্য সভাপতিরা- সাল ভিত্তিক
১) হরিপদ ভারতী (১৯৮০-৮২)
১৯৭৭ সালে জোড়াবাগান বিধানসভা কেন্দ্রে জিতে জনতা পার্টির বিধায়ক নির্বাচিত হয়েছিলেন হরিপদ ভারতী। হাওড়ার নরসিংহ দত্ত কলেজের অধ্যাপক তথা নেতা হরিপদ ভারতী-ই ছিলেন পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির প্রথম রাজ্য সভাপতি। তাঁকে মাস্টার মশাই নামে ডাকা হত। "মাস্টার মশাই"হরিপদ দত্তই ছিলেন ভারতীয় জনতা পার্টি, পশ্চিমবঙ্গ ইউনিটের প্রথম সভাপতি। তিনি ১৯৬৭ লোকসভা নির্বাচনে জনসংঘ প্রার্থী হয়ে কলকাতা উত্তর পশ্চিম কেন্দ্রে লড়ে হেরেছিলেন। এরপর এই কেন্দ্রেই ১৯৭১ লোকসভায় নির্দল প্রার্থী হয়ে ৩৫ হাজারের কাছাকাছি ভোট পেয়ে হেরেছিলেন। বিজেপির রাজ্য সভাপতি হয়ে প্রথমবার ভোটে লড়ে যাদবপুর থেকে হেরেছিলেন। বঙ্গ বিজেপির পথ চলা শুরু হরিপদ ভারতী-র হাত ধরেই।
২) বিষ্ণুকান্ত শাস্ত্রী (১৯৮২-৮৬)
লেখক, দার্শণিক, প্রশাসক বিষ্ণুকান্ত শাস্ত্রী ছিলেন বাংলায় বিজেপির দ্বিতীয় রাজ্য সভাপতি। তাঁর আমলে রাজ্যের প্রতিটি জেলায় বঙ্গ বিজেপির সংগঠন ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ শুরু হয়। পরবর্তীকালে তিনি রাজ্যসভার সাংসদ, এরপর তারপরে উত্তর প্রদেশ ও হিমাচল প্রদেশের রাজ্যপাল হন।
৩) সুকুমার বন্দোপাধ্যায় (১৯৮৬-৯১)
দেশের স্বাধীনতার আগেই সুকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় আরএসএসের সঙ্গে যুক্ত হন। পাশাপাশি তিনি জনসঙ্ঘের গুরুত্বপূর্ণ নেতাও ছিলেন। তিনি ছিলেন বাংলায় বিজেপির তৃতীয় রাজ্য সভাপতি। বিজেপিতে তাঁর আমলে উত্তরবঙ্গে পার্টির কাজকর্ম শুরু হয়। । আরএসএসের প্রাক্তন প্রচারক সুকুমারবাবু প্রথম বার বিজেপির রাজ্য সভাপতি ছিলেন ১৯৮৫ থেকে ’৯০ সাল পর্যন্ত।
৪) তপন সিকদার (১৯৯১-১৯৯৫)
সাহসী নেতা। ভাল সংগঠক। তাঁর লক্ষ্য ছিল হিন্দুত্ববাদের জনসেবামূলক কর্মসূচির সঙ্গে বামপন্থার লড়াই। জ্যোতি বসুর সরকারের সন্ত্রাস নিয়ে তিনি দলের নেতাদের পথে নামার নির্দেশ দেন। ভোটে তাঁর কিছুটা হলেও সুফল পায় বিজেপি।
৫) বিষ্ণুকান্ত শাস্ত্রী (১৯৯৫-৯৭)
৯ বছর পর ফের বিষ্ণুকান্ত শাস্ত্রী-কে বিজেপির রাজ্য সভাপতি বসান লালকৃষ্ণ আদবাণী। বাংলায় ভাল ফলের আশায় বিষ্ণুর দিকে চেয়ে থাকলেও প্রত্যাশিত ফল আসেনি।
৬) তপন সিকদার (১৯৯৭-৯৯)
দু বছর পর তপন সিকদারকে ফের রাজ্য সভাপতির পদে বসানো হয়। বাম সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে বিজেপির মমতা বন্দ্য়োপাধ্যায়ের হাত ধরার পিছনে তপন সিকদারের ভূমিকা ছিল। তৃণমূলের সমর্থনে ১৯৯৯ লোকসভা ভোটে দমদম কেন্দ্রে সিপিএমের অমিতাভ নন্দীকে হারিয়ে বিজেপি প্রার্থী হিসেবে জয় পান তপন সিকদার। সেটাই ছিল বাংলায় বিজেপির প্রথম আসন জয়। অটল বিহারী বাজপেয়ী মন্ত্রিসভায় টেলি যোগাযোগ দফতরের মন্ত্রী হলে তিনি পদ ছাড়েন।
৭) অসীম ঘোষ (১৯৯৯-২০০২)
বাংলায় ২০০১ বিধানসভা ভোটে অসীম ঘোষের নেতৃত্বে লড়ে বিজেপি। কেন্দ্রে ক্ষমতায় থাকলেও একা লড়ে তেমন ভাল ফল হয়নি বিজেপির।
৮) তথাগত রায় (২০০২-০৬)
দাপুটে নেতা। কথায় ঝড় তোলেন। মিডিয়ায় দলের বক্তব্য ভালভাবে পেশ করেন। তবে রাজ্যে দলের সংগঠনে বসে তেমন কিছু করতে পারেননি। তথাগতের আমলে ২০০৬ বিধানসভা ভোটে তৃণমূলের সঙ্গে জোট গড়ে ২৯টি আসনে লড়ে একটা আসন জেতা তো দূরে থাক, বিজেপি দু শতাংশেরও কম ভোট পেয়েছিল।
৯) সুকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় (২০০৬-০৮)
১৯৮৬ থেকে ১৯৯১ এবং ২০০৬ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত দুই দফায় সুকুমার রাজ্য বিজেপির সভাপতি ছিলেন।
১০) সত্যব্রত মুখোপাধ্যায় (২০০৮-০৯)
লড়াকু, শিক্ষিত নেতা। কৃষ্ণনগরের প্রাক্তন সাংসদ, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। তাঁর ডাকনাম ছিল জলু। তাঁর আমলে রাজ্য বিজেপিতে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের জমি তৈরি হয়েছিল। দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় বিজেপির সংগঠন মজবুত হয়।
১১) রাহুল সিনহা (২০০৯-১৫)
টানা ৬ বছর রাজ্যে বিজেপির সভাপতি ছিলেন রাহুল সিনহা। তাঁর প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনী রেকর্ড যতটা খারাপ, ততটা খারাপ নয়, দলীয় সভাপতি হিসেবে রেকর্ড। রাজ্য বিজেপিতে তাঁর আমলেই রাজ্য পালাবদল ঘটে। ৩৪ বছরের বাম জমানার অবসান ঘটিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হন। বাম ও তৃণমূল দুই জমানাতেই তিনি বাংলায় বিজেপির প্রধান হিসেবে কাজ করেও দলকে প্রত্যাশিত সাফল্য এনে দিতে পারেননি। তবে ২০১৪ লোকসভায় দেশজুড়ে চলা নরেন্দ্র মোদী ঝড়ের মাঝে বাংলায় দুটি লোকসভা আসনে জিতেছিল বিজেপি। সেবারই প্রথম নিজেদের শক্তিতে ভোটে লড়ে আসানসোল, ও দার্জিলিংয়ে জেতে বিজেপি। তার কয়েক মাস পরেই বসিরহাট উপনির্বাচনে জেতেন শমীক ভট্টাচার্য, প্রথমবার বঙ্গ বিধানসভায় ঢোকে বিজেপি। বঙ্গে বিজেপির দুটি ঐতিহাসিক ঘটনার সময় রাহুল সিনহা দায়িত্বে থাকলেও তাঁর ভূমিকা তেমন বড় ছিল না। কারণ সেই সময় মোদী ঝড় একটা বড় ফ্যাক্টার ছিল। রাহুল এরপরেও সেভাবে বঙ্গে বিজেপির সংগঠন সাজাতে পারেননি বলে বিশেষজ্ঞদের মত ছিল।
১২) দিলীপ ঘোষ (২০১৫-২১)
বঙ্গ বিজেপি সভাপতিদের মধ্যে ভোটের রেকর্ডের বিষয়ে অবশ্যই সফলতম দিলীপ ঘোষ। খড়গপুর বিধানসভা ভোটে জিতে এসে মেদিনীপুরের সাংসদ- ভোটে দিলীপ রাজ্য সভাপতি থাকাকালীন অপরাজেয় ছিলেন। দিলীপের নেতৃত্বে ২০১৯ লোকসভা ভোটে রেকর্ড ১৮টি আসনে জেতে। মুকুল রায় থেকে শুভেন্দু অধিকারীদের বিজেপিতে এনে দিলীপই মমতাকে সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা দিতে পেরেছিলেন। তিনি ঠোঁটকাটা, বেঁফাস মন্তব্য করে দলকে অস্বস্তিতে ফেলেছেন। এই নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। তেমন এটা নিয়েও সন্দেহ নেই, বঙ্গ বিজেপিতে সাফল্যের বিচারে দিলীপকে টেক্কা দেওয়া কঠিন।
১৩) সুকান্ত মজুমদার (২০২১-২৫)
বালুরঘাটের সাংসদ থেকে অধ্যাপক সুকান্ত মজুমদারকে বঙ্গ বিজেপির প্রধান করা হয়। দিলীপ ঘোষের পর অনেক আশায় সুকান্তকে বঙ্গ বিজেপির দায়িত্ব দিয়েছিলেন শাহ-নাড্ডা-রা। কিন্তু সুকান্ত মজুমদারের নেতৃত্বে লড়ে বাংলায় বিজেপি কখনই প্রত্যাশিত সাফল্য পায়নি। সুকান্তর নেতৃত্বে ২০২১ বিধানসভায় মোদী-শাহর অনেক চেষ্টার পরেও বিজেপি মাত্র ৭৭টি আসন জেতে। তারপর ২০২৪ লোকসভায় শুভেন্দু, সৌমিত্র-শান্তনুদের ব্যক্তিগত ক্য়ারিশ্মা ছাড়া বাংলায় বিজেপি পুরোপুরি ধরাশায়ী হয়। বিভিন্ন পুরসভা, পঞ্চায়েত, বিধানসভা উপনির্বাচনেও সুকান্তর ফর্মুলায় লড়ে বাংলা জুড়ে বিজেপি কার্যত ভরাডুবি হয়। সুকান্তর আমলেই বিজেপিতে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব তুঙ্গে ওঠে। দিলীপের ছেড়ে যাওয়া সাজানো বাগানকে সেভাবে যত্ন করতে পারেননি সুকান্ত। এমন কথাই বলেন বাংলা রাজনীতির বিশেষজ্ঞরা।
১৪) শমীক ভট্টাচার্য (২০২৫ থেকে শুরু)
এবার শমীক ভট্টাচার্যর পথ চলা শুরু হচ্ছে। সামনে কঠিন চ্যালেঞ্জ। রাজ্য বিজেপির অবস্থা তেমন ভাল নয়। বাংলায় ১৫ বছর ধরে চলা মমতা বন্দ্য়োপাধ্যায়ের সরকারের বিরুদ্ধে বিজেপিকে ২০২৬ নির্বাচনে কঠিন চ্যালেঞ্জ তুলে ধরতে হলে শমীক ভট্টাচার্যকে দলের সংগঠনকে চাঙ্গা করতে হবে।
রাজ্য বিজেপির প্রাক্তন সভাপতিরা- এক নজরে
হরিপদ ভারতী (১৯৮০-৮২)
বিষ্ণুকান্ত শাস্ত্রী (দু দফায়)
সুকুমার বন্দোপাধ্যায় (দু দফায়)
তপন সিকদার (দু দফায়)
অসীম ঘোষ (১৯৯৯-২০০২)
সত্যব্রত মুখোপাধ্যায় (২০০৮-০৯)
রাহুল সিনহা (২০১৯-১৫)
দিলীপ ঘোষ (২০১৫-২১)
সুকান্ত মজুমদার (২০২১-২৫)
শমীক ভট্টাচার্য (বর্তমান)
(টুইটার, ইনস্টাগ্রাম এবং ইউটিউব সহ সোশাল মিডিয়া থেকে আপনার কাছে সর্বশেষতম ব্রেকিং নিউজ, ভাইরাল ট্রেন্ডস এবং ইনফরমেশন নিয়ে আসে SocialLY। উপরের পোস্টটি ব্যবহারকারীর সোশাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট থেকে সরাসরি এম্বেড করা হয়েছে এবং লেটেস্টলি এতে কোনও সংশোধন বা সম্পাদনা করেনি। সোশাল মিডিয়া পোস্টের মতামত এবং তথ্য লেটেস্টলি-র মতামতকে প্রতিফলিত করে না। লেটেস্টলি এর জন্য কোনও দায়বদ্ধতা বা দায় গ্রহণ করে না।)