সত্তরের দশকে কলকাতার বড় পুজো বলতে ৩টে নাম মাথায় আসত। ফাটাকেষ্টর কালী পুজো, সৌমেন মিত্রের কালীপুজো এবং মহম্মদ আলি পার্কের কালীপুজো। তবে সেই সত্তরের দশকেই গঙ্গার ধারে আর এক পুজো হত, যেখানে মায়ের মূর্তি ছিল ৪০ ফুটের চেয়ে বেশি। বর্তমানে সেই পুজো উত্তর কলকাতাতেই অবস্থিত, পেল্লায় সাইজের ঠাকুরের হাতে ৬ ফুটের খাঁড়া। ২২ কেজি ওজনের নিরেট রুপোর। আর আভরণ? জিভ থেকে শুরু করে করে কানের দুল, নাকের নথ সবই খাঁটি সোনা ও রুপোর। সবমিলিয়ে ঐতিহ্যে ও আভিজাত্যে আজও অমলিন উত্তর কলকাতার পাথুরিয়াঘাটা সর্বজনীন কালীপুজো।
পাথুরিয়াঘাটা বড় কালী পুজোর সূচনা ১৯২৮ সালে। অধুনা নিমতলা ঘাট স্ট্রিট লাগোয়া প্রসন্ন কুমার ঠাকুর ঘাট চত্বরে। মহান বিপ্লবী বাঘাযতীনের হাত দিয়ে এই পুজোর শুরু। তবে অনেকে বলেন স্বদেশী আন্দোলনের সময় বিখ্যাত লাঠিয়াল অতুল কৃষ্ণ ঘোষ, যিনি রঘু ডাকাতের ভাব শিষ্য, তিনি এই পুজোর প্রবর্তক। সে সময় স্বদেশীরা শক্তির উপাসনা করতেন। তাই কালীপুজোর সূচনা। তারপর একে একে আরও মহান নাম যুক্ত হয়েছে পাথুরিয়াঘাটার ‘বড় কালী’র সঙ্গে। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, ভূপেন বোস, মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র, মহারাজা শ্রীশচন্দ্রের মতো মহান ব্যক্তিত্বদের স্মৃতিধন্য এই কালীপুজো এবার ৯৮ তম বর্ষে পা রাখল। পাথুরিয়াঘাটা ব্যায়াম সমিতি পরিচালিত এই বারোয়ারি পুজো নামেই সর্বজনীন। বনেদি বাড়ির পুজোর মতোই এর রীতি-আচার। পুজোর শুরু থেকে শেষ, সবকিছুতেই অবাক করার মতো উপাদান রয়েছে।
১৯৫৬ সালে পুজোর স্থান পরিবর্তন হয়। ঘাট থেকে তা সরে আসে মাঠে। অধুনা যেখানে বিনানি ধর্মশালা, সেখানে তখন ফাঁকা মাঠ। সেই মাঠে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত পুজো হল। তারপর তা স্থায়ী ভাবে সরে এল ২২ নম্বর যদুনাথ মল্লিক রোডের এই জমিতে। সেই থেকে আজ পর্যন্ত এখানেই ৩২ ফুটের সুবিশাল এবং কলকাতার বৃহত্তম কালী পুজো হয়ে আসছে। মায়ের উচ্চতা ৩২ ফুট। মায়ের রুপোর খাঁড়ার দৈর্ঘ্য ৬।মায়ের রুপোর খাঁড়া দান করেছিলেন নরেণ পোদ্দার। রুপোর নর করোটি ৩ ফুট। রুপোর পান পাতা ১ ফুট। সোনা ও রূপো মিলিয়ে মায়ের গায়ে ৭৫ কিলো গয়না বা অলঙ্কার থাকে।রীতি মেনে পুজোর দিন আড়াই ফুটের একটি রুপোর মঙ্গলঘটে করে গঙ্গা থেকে জল আনা হয়। এরপর মায়ের উদ্দেশে ৫৬ ভোগ নিবেদিত হয়।রাজ বেশেই মাকে বিসর্জনের দিন ৯ কিলোমিটার রাস্তা জুড়ে শোভা যাত্রা করানো হয়। বিসর্জনের দিন আরও আশ্চর্য জিনিস হয়। পুজোর পুরুষ সদস্যরা ধুতি-পাঞ্জাবি ও মহিলারা আটপৌড়ে লালপেড়ে সাদা শাড়ি পরে শোভাযাত্রায় অংশ নেন। এবং প্রত্যেকেই খালি পায়ে হাঁটেন। পুজোর পরের দিন দেখার মতো এদের অন্নকূট উৎসব। প্রায় তিন থেকে চার হাজার মানুষ পাতপেড়ে খান এখানে। মঙ্গলারতি দেখতে জড়ো হন প্রচুর মানুষ।
ইতিহাসসমৃদ্ধ এই কালীপুজো নিয়ে পাথুরিয়াঘাটা অঞ্চলে উৎসাহ-উদ্দীপনার শেষ নেই। বারোয়ারি হলেও স্থানীয়রা বেশ ভক্তি-শ্রদ্ধা করেন বড় কালীর। এত বড় প্রতিমা বিসর্জনের সময় কম ঝক্কি পোহাতে হয় না উদ্যোক্তাদের। তবে স্থানীয় মানুষ ও পুলিশ-প্রশাসনের সহযোগিতায় নির্বিঘ্নেই মেটে সব। জৌলুসে শহরের অন্যান্য পুজোগুলিকেও সমান টক্কর দেয় পাথুরিয়াঘাটা সর্বজনীন।