Netaji Subhas Chandra Bose Birth Anniversary: স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ও আজাদ হিন্দ বাহিনী

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ দিকে ইঙ্গ-মার্কিন বাহিনীর আক্রমণে জাপান বিধ্বস্ত হয়ে পড়লে, জাপানের কাছ থেকে 'আজাদ হিন্দ ফৌজের' সাহায্যে সম্ভাবনা শেষ হয়ে যায়। অবশেষে জাপানিদের দ্বারা অস্ত্র, খাদ্য সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেলে ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে শেষমেষ আজাদ হিন্দ বাহিনী কে আত্মসমর্পণ করতে হয়।

Netaji And INA

আগামী ২৩শে জানুয়ারি ভারতবর্ষের বীর সন্তান নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর জন্মদিন। তাঁর আগে আজ আমরা দেখে নেব ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে সুভাষচন্দ্র বসু ও তাঁর নেতৃত্বাধীন আজাদ হিন্দ বাহিনীর অবদানের কথা। নেতাজী ডাক দিয়েছিলেন দিল্লি চলো তবে আজাদ হিন্দ ফৌজের সেনারা দিল্লী পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেননি ঠিকই, কিন্তু তা সত্ত্বেও ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে আজাদ হিন্দ ফৌজ দেশের মুক্তি তথা স্বাধীনতার জন্য যে লড়াই চালিয়েছিল তা ছিল সকল প্রশংসার ঊর্ধ্বে। তাই 'গান্ধীজী' নিজে বলেছেন- "যদিও আজাদ হিন্দ ফৌজ তাদের লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেনি, কিন্তু তা সত্বেও তারা এমন কিছু করেছে, যে জন্য তারা গর্ববোধ করতে পারে।"

আজাদিন বাহিনীর প্রেক্ষিতে সুভাষ চন্দ্রের অবদান-

১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের ২ জুলাই সুভাষচন্দ্র কে ভারত রক্ষা আইনে গ্রেফতার করে তার নিজ গৃহে বন্দী করে রাখা হয়। কিন্তু তা সত্বেও সুভাষচন্দ্র মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিন নামে ছদ্মবেশে সেখান থেকে পালিয়ে দেশত্যাগ করেন।দেশত্যাগের পরে সুভাষচন্দ্র বসু বিদেশী সাহায্য লাভের চেষ্টা করেন। তিনি সবার প্রথমে রাশিয়ার কাছে ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য সাহায্য প্রার্থনা করেন। কিন্তু রুশ রাষ্ট্রপ্রধান স্ট্যালিনের কাছ থেকে কোনরকম সাহায্যের আশ্বাস পাননি তিনি। এরপর তিনি ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের ২৮ শে মার্চ জার্মানিতে পৌঁছান। সেখানে তিনি ২০ জন ভারতীয়কে নিয়ে 'ফ্রি ইন্ডিয়া- সেন্টার' গড়ে তোলেন।এরপরে কিছুদিনের মধ্যেই ইউরোপ ও উত্তর আফ্রিকার ভারতীয় যুদ্ধবন্দীদের নিয়ে ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে তিনি গঠন করেন 'ফ্রী ইন্ডিয়া আর্মি'। সুভাষচন্দ্র বসু হিটলারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী রিবেনট্রপ এর সঙ্গে দেখা করেন ও ভারতীয় মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে পরিকল্পনা পেশ করেন। জার্মান সরকার সুভাষচন্দ্রের পরিকল্পনার অন্যান্য শর্ত গুলি মেনে নিলেও, ভারতীয় স্বাধীনতা সম্পর্কিত কোনো প্রতিশ্রুতি দিতে রাজি হয়নি।সুভাষচন্দ্র বসু জাপানের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার উদ্দেশ্যে ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে ১৩ই জুন টোকিও-তে পৌঁছান। সেখানে গিয়ে তিনি জাপানের প্রধানমন্ত্রী তোজোর সঙ্গে বৈঠকের মাধ্যমে ইংরেজদের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের মুক্তি সংগ্রামে জাপানের পূর্ণ সহায়তা লাভ করেন। বাস্তবায়িত হয় সুভাষের স্বপ্নের অভিযান।

আজাদ হিন্দ বাহিনী গঠন-

 জাপানে প্রবাসী ভারতীয় বিপ্লবী রাস বিহারী বসু সকল ভারতীয়দের সংগঠিত করার উদ্দেশ্যে ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ১৫ই জুন ব্যাংককের স্বাধীনতাকামী ভারতীয়দের এক সম্মেলন আহ্বান করেন। এই সম্মেলনে রাসবিহারী বসুর সভাপতিত্বে গঠিত হয় ভারতীয় স্বাধীনতা সংঘ বা ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লীগ। এরপরে সিঙ্গাপুরে ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ১ সেপ্টেম্বর মোহন সিং এর সক্রিয় সহযোগিতায় ২৫ হাজার (পরে বেড়ে ৪০ হাজার) ভারতীয় সেনা নিয়ে 'আজাদ হিন্দ ফৌজ' গঠন এর কথা প্রকাশ্যে ঘোষণা করা হয়। এক্ষেত্রে তে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন রাসবিহারী বসু ও মোহন সিং। ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে সুভাষচন্দ্র জাপানে এলে রাজবিহারী বসু সুভাষকে 'আজাদ হিন্দ ফৌজ' এর নেতৃত্ব গ্রহণে আহ্বান জানান। তার ডাকে সাড়া দিয়ে সুভাষচন্দ্র বসু ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের ২৫ শে আগস্ট 'আজাদ হিন্দ বাহিনীর' নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। মোহন সিং ছিলেন এর প্রধান সেনাপতি।

আজাদ হিন্দ ফৌজের পুনর্গঠন

আজাদ হিন্দ বাহিনীর নেতৃত্ব গ্রহণের পর সুভাষ একে নতুন করে সাজিয়ে তোলেন।সুভাষচন্দ্র সর্বাধিনায়ক হয়ে আজাদ হিন্দ ফৌজের পুনর্গঠন করেন।(i) আজাদ হিন্দ ফৌজে যােগ দেওয়ার জন্য জাপানের হাতে বন্দি ভারতীয় সৈন্যদের সংগঠিত করা হয়। ২০ হাজার ভারতীয় সেনা ফৌজে যােগ দেন।(iii) সুভাষ আজাদ হিন্দ ফৌজকে পাঁচটি ব্রিগেডে বিভক্ত করেন। লক্ষ্মী স্বামীনাথন এর নেতৃত্বে - ঝাঁসির রানি নামে একটি নারী বাহিনী বা ব্রিগেড গঠন করা হয় এবং নিজের অনিচ্ছা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত অনুগামীদের অনুরোধে নিজের নামে সুভাষ ব্রিগেড গঠন করা হয়। এছাড়া অন্য তিনটি ব্রিগেড হলো-গান্ধী ব্রিগেড, নেহেরু ব্রিগেড, আজাদ ব্রিগেড

 

আজাদ হিন্দ সরকার প্রতিষ্ঠা-

সুভাষচন্দ্র বসু সিঙ্গাপুরে ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে ২১শে অক্টোবর 'আজাদ হিন্দ সরকার' গঠনের কথা ঘোষণা করেন। এই সরকারের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু নিজেই। জাপান, জার্মানিসহ আরো ৬ টি রাষ্ট্র এই অস্থায়ী সরকারকে স্বীকৃতি দেয়।জাপান সরকার তার অধিকৃত আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ 'আজাদ হিন্দ সরকারকে' অর্পণ করে। এদের নতুন নাম হয় যথাক্রমে শহিদ ও স্বরাজ দ্বীপ। পরাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসাবে সুভাষচন্দ্র ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের ৩১ ডিসেম্বর আন্দামানে উপস্থিত হয়ে স্বাধীন ভারতের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। জয় হিন্দ' ধ্বনি দিয়ে তিনি বাহিনীর জওয়ানদের উদ্বুদ্ধ করেন। নেতাজি ঘোষণা করেন 'আজাদ হিন্দ সরকারের' প্রধান লক্ষ্য হলো ভারত থেকে ব্রিটিশ শাসনের উৎখাত করা।তিনি যুব সমাজের মনে আগুন জ্বালিয়ে বলেন -

"তােমরা আমাকে রক্ত দাও,আমি তােমাদের স্বাধীনতা দেব।"

তিনি আরো বলেন-

"দিল্লি চলাে।"

আজাদ হিন্দ ফৌজের ভারত অভিযান-

আন্দামান থেকে সুভাষচন্দ্র ব্রহ্মদেশে  যান এবং সেখান থেকে ভারত অভিযান শুরু করেন। প্রথমে আজাদ হিন্দফৌজ আরাকান দখল করে (৪ ফেব্রুয়ারি , ১৯৪৪ খ্রি.)।এরপর ১৮ মার্চ 'আজাদ হিন্দ ফৌজ' ব্রহ্মদেশে অতিক্রম করে ভারতের মাটি স্পর্শ করে। মণিপুরের মৈরাং-এ ভারতের জাতীয় পতাকা উত্তোলন (১৪ এপ্রিল) করা হয়। মণিপুরের কোহিমা শহরটি 'আজাদ হিন্দ ফৌজ' দখল করে। এরপর শুরু হয় ইম্ফল দখলের লড়াই। কিন্তু, প্রবল প্রকৃতিক বিপর্যয় ও অন্যান্য একাধিক কারণ এই ফৌজের সব ধরনের প্রয়াসকে ব্যর্থ করে দেয়।এরপরই শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ দিকে ইঙ্গ-মার্কিন বাহিনীর আক্রমণে জাপান বিধ্বস্ত হয়ে পড়লে, জাপানের কাছ থেকে 'আজাদ হিন্দ ফৌজের' সাহায্যে সম্ভাবনা শেষ হয়ে যায়। অবশেষে জাপানিদের দ্বারা অস্ত্র, খাদ্য সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেলে ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে শেষমেষ আজাদ হিন্দ বাহিনী কে আত্মসমর্পণ করতে হয়।

সুভাষচন্দ্রের নেতৃত্বে আজাদ হিন্দ ফৌজের লড়াই ভারতের স্বাধীনতার প্রশ্নকে একটি আন্তর্জাতিক বিষয়ে উন্নীত করে। আজাদি সেনাদের নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগ ও আত্মবলিদান প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ভারতবাসীকে দেশাত্মবােধে উদ্বুদ্ধ করবে, এ বিষয়ে কোনাে সন্দেহ নেই। গান্ধীজী বলেছেন, তাঁরা একই পতাকাতলে ভারতের সব ধর্ম ও জাতির মানুষকে একত্রিত করেছিলেন। ধর্মীয় ভেদ বুদ্ধির উর্ধ্বে তাঁরা একতা ও সংহতির আদর্শ সঞ্চারিত করেছিলেন।