Lok Sabha Elections 2024 West Bengal: রাজ্যের যে ১৫টি আসনে লুকিয়ে রয়েছে বাংলা জয়ের ফর্মুলা, জানুন এগিয়ে কারা
পার্থ প্রতিম চন্দ্র: ভোটের দামামা বেজে গিয়েছে। রাজ্যের অধিকাংশ আসনেই প্রার্থীদের নাম ঘোষিত হয়ে গিয়েছে। প্রার্থীরা জোর কদমে প্রচারও শুরু করেছেন। গোটা দেশের নজর বাংলার ৪২টি লোকসভা আসনের দিকে। বিজেপি কি পারবে গতবারের ১৮টি আসন জয়ের রেকর্ডকে ছাপিয়ে যেতে? নাকি ২০২১ বিধানসভার মত মমতা ঝড়ে উড়ে যাবে পদ্মশিবির। এই প্রশ্নের উত্তরের চাবিকাঠি লুকিয়ে রয়েছে মূলত এই ১৫টি লোকসভা আসনে। বাকি আসনগুলিতে জয়-পরাজয়ের হিসেবটা মোটের ওপর পরিষ্কার। যদিও সেইগুলোতেও লড়াই হবে। কিন্তু এই ১৫টি কেন্দ্রে যারা বাজিমাত করবে, বল তাদের কোর্টেই থাকবে।
এক নজরে সেই ১৫টি লোকসভা কেন্দ্র
১) বালুরঘাট: বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার বনাম রাজ্যের মন্ত্রী বিপ্লব মিত্র। একেবারে সমানে সমানে লড়াই। গতবার তৃণমূলের অর্পিতা ঘোষকে হারিয়ে প্রথমবার সাংসদ হয়েছিলেন অধ্যাপক সুকান্ত মজুমদার। এবার এই আসনে জোর টক্কর। কারণ হরিরামপুরের বিধায়ক বিপ্লব মিত্র এই কেন্দ্রকে হাতের তালুর মত চেনেন। ২০০৯ লোকসভায় আরএসপি গড় হিসেবে পরিচিকত বালুরঘাটে দলের তেমন কোনও সংগঠন ছাড়াই ৩ লক্ষ ৮৩ হাজার ভোট পেয়েছিলেন। শেষে অবশ্য মাত্র পাঁচ হাজার ভোটে আরএসপি-র প্রশান্ত মজুমদারের কাছে হেরে গিয়েছিলেন বিপ্লব। এরপর টানা দুটো লোকসভা ভোটে তাঁকে আর টিকিট দেয়নি দল। ক্ষোভে দল ছেড়েছিলেন। কিন্তু তৃণমূল অন্তপ্রাণ বিপ্লব, ফের দিদির কথা শুনে ফিরে এসে দলের হাল ধরেন। সুকান্ত মজুমদার এখানে দলের সংগঠন তৈরি করতে পেরেছেন।
২) রায়গঞ্জ: ত্রিমুখি লড়াই। গতবারের জয়ী দেবশ্রী চৌধুরীকে এবার আর রায়গঞ্জে টিকিট দেয়নি বিজেপি। তার বদলে কালিয়াগঞ্জের পুরপ্রধান কার্তিক পাল পদ্ম প্রার্থী হয়েছেন। প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সির গড় রায়গঞ্জ লোকসভা এখনও পর্যন্ত কখনও জেতেনি তৃণমূল। এবার তৃণমূল প্রার্থী করেছে বিজেপি থেকে আসা কৃষ্ণ কল্যাণী-কে। কংগ্রেস প্রার্থী আলি ইমরান রামজ (ভিক্টর) এখানে বড় ফ্যাক্টর। গত লোকসভা ভোটে এখানে বিজেপি-র দেবশ্রী চৌধুরী নিকটতম তৃণমূল প্রার্থী কানাইল লাল আগরওয়ালের বিরুদ্ধে জিতেছিলেন ৬০ হাজারের মত ভোটে, সেখানে সিপিএম প্রার্থী মহম্মদ সেলিম ১ লক্ষ ৮৩ হাজার ভোট পেয়েছিলেন। রায়গঞ্জ লোকসভার ৭টি-র মধ্যে ৬টি-তেই তৃণমূলের বিধায়ক। একমাত্র কালিয়াগঞ্জ বিধানসভা বিজেপির দখলে আছে। কংগ্রেস প্রার্থী ভিক্টরের ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে।
৩) মালদা উত্তর: ত্রিমুখি লড়াই। একেবারে সমান সমান সম্ভাবনা। গতবারের জয়ী বিজেপি-র খগেন মুর্মু এবার কিছুটা অস্বস্তিতে। কারণ এবার গতবারের মত তৃণমূল ও কংগ্রেসের স্পষ্ট বিভাজন নাও হতে পারে। ২০১৯ লোকসভায় খগেন মুর্মু পেয়েছিলেন ৫ লক্ষ ৯ হাজার ৫৩৪ ভোট। সেখানে দ্বিতীয় স্থানে থাকা তৃণমূলের মৌসম নুর পেয়েছিলেন ৪ লক্ষ ২৫ হাজার ভোট, আর কংগ্রেসের ঈশা খান চৌধুরী ৩ লক্ষ ৫ হাজার ভোট। তার মানে দুই কংগ্রেসের মিলিত ভোট ছিল ৭ লক্ষ ২৫ হাজারের মত। এবার তৃণমূল প্রার্থী করেছে অবসরপ্রাপ্ত আইপিএস প্রসূণ ব্যানার্জি-কে। আর এবার কংগ্রেসের প্রার্থী মোস্তাক আলম হলেন গণি খানের শিষ্য। আগে হরিশচন্দ্রপুরের বিধায়কও ছিলেন। লড়াই তাই ৩৩:৩৩:৩৩। ২০২১ লোকসভা নির্বাচনে এই বিধানসভার চারটিতে তৃণমূল (হরিশচন্দ্রপুর, মালতিপুর, রাতুয়া, ও চাঁচল) ও তিনটি-তে বিজেপি (হাবিবপুর, গাজোল, মালদা-তিনটিই সংরক্ষিত) জিতেছিল।
৪) মুর্শিদাবাদ: তৃণমূল বনাম সিপিএমের সরাসরি লড়াই। সিপিএম এখানে মহম্মদ সেলিমকে প্রার্থী করার পর খেলা জমে গিয়েছে। ২০১৯ লোকসভায় এই আসনে তৃণমূলের আবু তাহের খান ২ লক্ষ ২৫ হাজারের বেশী ভোটে নিকটতম কংগ্রেস প্রার্থী আবু হেনা-কে হারিয়েছিলেন। সেখানে বিজেপি প্রার্থী হুমায়ন কবীর ২ লক্ষ ৪৭ হাজার ভোট পেয়ে তৃতীয় হয়েছিলেন। মহম্মদ সেলিম যদি কংগ্রেসের ভোটব্যাঙ্কের পুরোটা পেয়ে যান, তাহলে খেলা জমতে পারে। তৃণমূল ও সিপিএমের সংখ্যালঘু ভোট ভাগাভাগিতে তাদের প্রার্থী গৌরী শঙ্করের জয়ের আশায় বিজেপি। ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনে মুর্শিদাবাদে একমাত্র যে আসনে জিতেছিল বিজেপি, সেই বিধায়ক গোরীশঙ্করই লোকসভায় পদ্ম প্রার্থী।
৫) বহরমপুর: অধীর গড়ে দেশের প্রাক্তন ক্রিকেটার ইউসুফ পাঠান প্রার্থী করেছে তৃণমূল। এবারও কি ছক্কা হাঁকাবেন অধীর। বহরমপুরে কংগ্রেস গড়ে ফাটল ধরিয়েছে তৃণমূল, তা নিয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু অধীর ম্যাজিককে কি ছক্কা হাঁকিয়ে মাঠের বাইরে বের করতে পারবেন ইউসুফ?
৬) কৃষ্ণনগর: একের পর এক মামলায় জর্জরিত হলেও মহুয়া মিত্র-কে ফের এখানে প্রার্থী করেছে তৃণমূল। কৃষ্ণনগরে মহুয়ার বিরুদ্ধে বিজেপি দাঁড় করিয়েছে রাজমাতা অমৃতা রায়। কৃষ্ণনগরের রাজ পরিবারের সদস্য অমৃতা রায়কে দাঁড় করিয়ে তৃণমূলকে হারাতে মরিয়া শুভেন্দু অধিকারী। এই লোকসভায় জয়ের চাবিকাঠি কালীগঞ্জ, পলাশীপাড়া ও চাপড়া বিধানসভা। মহুয়া এই বিধানসভায় লিড না পেলে বিজেপি-র রাজমাতা অঘটন ঘটাতে পারেন।
৭) বসিরহাট: সন্দেশখালির গৃহবধূ রেখা পাত্র-কে বিজেপি প্রার্থী করার পর এই কেন্দ্র গোটা দেশের নজরে। টলিউড অভিনেত্রী নুসরত জাঁহানকে সরিয়ে ২০০৯ লোকসভায় জেতা সাংসদ হাজি নুরুল হাসান-কে প্রার্থী করেছেন দিদি। এমনিতে তৃণমূল অনেকটাই এগিয়ে। কংগ্রেস, বাম প্রার্থীর ওপর বিজেপি কতটা লড়াই দেয় সেটা দেখার। নুরুল ইসলামের হাত ধরেই ২০০৯ সালে প্রথমবার বসিরহাট লোকসভায় জয়ের স্বাদ পেয়েছিল তৃণমূল।
৮) বারাকপুর: ভাটপাড়ার বিধায়ক বনাম নৈহাটির বিধায়ক। বারাকপুর লোকসভার লড়াই এবার জমজমাট। গত লোকসভায় দিদি তাঁকে টিকিট না দিয়ে দীনেশ ত্রিবেদি-কে টিকিট দেওয়ার ক্ষোভে দল ছেড়ে বিজেপি-তে যোগ দিয়ে জয় পেয়েছিলেন। এবারও একই রকম হল। মমতা প্রার্থী না করায় ফের বিজেপিতে ফিরে তৃণমূলের পার্থ ভৌমিকের বিরুদ্ধে প্রার্থী অর্জুন। অর্জুনের লক্ষ্যভেদ নাকি পার্থর অঙ্ক-সেটাই দেখার। তৃণমূলের শক্তি হল দলীয় সংগঠন। বিজেপির পুরোটাই নির্ভর করছে অর্জুনের ব্যক্তি ক্যারিশ্মা-র ওপর। সিপিএমের দাবি অর্জুনের আরেক নাম পার্থ। আবার মহাভারতে তো বলাই আছে, পার্থ আসলে অর্জুন। তাই বিজেপি-তৃণমূল গোপন আঁতাতে তাদেরই ভোট দেওয়া উচিত।
৯) উত্তর কলকাতা: সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় বনাম তাপস রায়। সুদীপের জন্যই তৃণমূল ছাড়েন বরানগরের বিধায়ক তাপস রায়। এবার সুদীপকে বিজেপির টিকিটে হারাতে মরিয়া তাপস। উত্তর কলকাতায় সুদীপ অপ্রতিরোধ্য। সেটা বারবার প্রমাণ হয়েছে। এবার কি সেই মিথ ভাঙতে পারবেন তাপস?
১০) তমলুক: অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি অভিজিত গঙ্গোপাধ্যায় বনাম তৃণমূলের খেলা হবে-র তরুণ নেতা দেবাংসু ভট্টাচার্য। দু জনের জোর লড়াই। অঙ্কের হিসেবে ৫০:৫০। বকলমে লড়াইয়ে শুভেন্দু বনাম অভিষেক। অনেক উত্তর মিলবে ৪ জুন।
১১) ঘাটাল: দুই অভিনেতা প্রার্থী। তৃণমূলের দেব বনাম বিজেপি-র হিরণ। দীপক অধিকারী বনাম হিরণ্ময় চট্টোপাধ্যায়-এর মধ্যে লড়াই জমজমাট। বক্স অফিসের লড়াইয়ে দেবকে কখনও হারাতে পারেননি হিরণ। ভোটের ময়দানে পারবেন খড়গপুরে বিধায়ক?
১২) মেদিনীপুর: দিলীপ ঘোষ নেই। মানস ভুঁইয়াও নেই। এবার লড়াই তৃণমূলের অভিনেত্রী-বিধায়ক জুন মালিয়া ও বিজেপির ফ্যাশান ডিজাইনার অগ্নিমিত্রা পল-এর মধ্যে। কঠিন লড়াই। অগ্নিমিত্রা গত বিধানসভায় আসানসোলে তৃণমূলের অভিনেত্রী-নেত্রী প্রার্থী সায়নী ঘোষ-কে হারিয়েছিলেন। তবে লোকসভায় শত্রুঘ্ন সিনহা-র কাছে বড় ব্যবধানে হেরেছিলেন। সেখানে জুন মালিয়া ২০২১ বিধানসভায় প্রথমবার নেমেই দারুণ জয় পান। জুন এগিয়ে আছেন দলীয় সংগঠনের জোরে। অগ্নিমিত্রা-কে জিততে হলে গতবার দিলীপ ঘোষের মত মাঠে নেমে পরিশ্রম করে ম্যাজিক দেখাতে হবে।
১৩) বর্ধমান দুর্গাপুর: বিজেপির পোড়খাওয়া রাজনীতিবিদ দিলীপ ঘোষ বনাম তৃণমূলের প্রাক্তন ক্রিকেটার কীর্তি আজাদ। কঠিন লড়াই। কে জিততে পারেন জানতে এখানে ক্লিক করুন।
১৪) হুগলি: বিজেপি-র অভিনেত্রী তথা বিদায়ী সাংসদ লকেট চট্টোপাধ্যায় বনাম দিদির নম্বর ওয়ান পছন্দ অভিনেত্রী রচনা বন্দ্যোপাধ্য়ায়। গতবারের মত এবারও জিততে হলে লকেট-কে অঘটন ঘটাতে হবে কিংবা তৃণমূলের অন্তর্ঘাতের অপেক্ষা করতে হবে। কারণ এই লোকসভার সাতটা বিধানসভাতেই তৃণমূল অনায়াসে জিতেছিল তিন বছর আগের বিধানসভা নির্বাচন। তার পর আর সেভাবে বিজেপির সংগঠন মাথাচাড়া দেয়নি। তবে একথাও ঠিক, ২০১৯ লোকসভাতেও রত্না দে নাগ-কে যখন ৭৩ হাজারের ব্যবধানে হারান লকেট, তখনও এই লোকসভায় বিজেপির কোনও বিধায়ক বা তেমন সাংগঠনিক প্রভাব ছিল না। লকেট কি জয়ের রচনা লিখতে পারবেন? নাকি জয়ের লকেটটা রচনাই পরবেন, সেটাই দেখার।
১৫) বাঁকুড়া: কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সুভাষ সরকার বনাম তৃণমূলের অরূপ চক্রবর্তী। জোর লড়াই। গত লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূলের সুব্রত মুখোপাধ্যায়-কে ১ লক্ষ ৭৫ হাজার ভোটে হারিয়ে চমকে দিয়েছিলেন ডাক্তারবাবু সুভাষ সরকার। বাঁকুড়া অবশ্য বারাবরই চমকে দেয়। ২০১৪ লোকসভা নির্বাচনে সিপিএমের পোড়খাওয়া নেতা বাসুদেব আচারিয়া-কে হারিয়ে দিয়েছিলেন তৃণমূলের অভিনেত্রী প্রার্থী মুনমুন সেন। অথচ সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের মত জনপ্রিয় নেতা দু বার এখান থেকে তৃণমূলের টিকিটে লড়ে জিততে পারেননি। এবার তৃণমূল এমন একজনকে প্রার্থী করেছে, সেই অরূপ চক্রবর্তী দলের সংগঠনকে বাঁকুড়ায় একেবারে মজবুত করেছেন। এবার কী কোনও চমক থাকবে বাঁকুড়ায়? সুভাষ সরকারকে হারাতে হলে চমকের দরকার তৃণমূলের।