Election Results 2024: বিজেপির হরিয়ানায় বাজিমাত থেকে কাশ্মীরে বিপর্যয়ের কারণ, মঙ্গলে ভোটের ফলের চুম্বকে ধরা পড়া দশটা জিনিস
আজ, মঙ্গলবার হরিয়ানা ও জম্মু-কাশ্মীর বিধানসভার ফল প্রকাশিত হল। সকাল থেকে টানটান উত্তেজনা, নাটকের পর দেখা গেল হরিয়ানায় টানা তিনবার জিতে রাজ্যের ক্ষমতায় ফিরল বিজেপি।
পার্থ প্রতিম চন্দ্র: আজ, মঙ্গলবার হরিয়ানা ও জম্মু-কাশ্মীর বিধানসভার ফল প্রকাশিত হল। সকাল থেকে টানটান উত্তেজনা, নাটকের পর দেখা গেল হরিয়ানায় টানা তিনবার জিতে রাজ্যের ক্ষমতায় ফিরল বিজেপি। অন্যদিকে, সংবিধানের ৩৭০ ধারা প্রত্যাহারের পর প্রথম ভোটে বিজেপি-কে পরাস্ত করল ন্যাশানল কনফারেন্স-কংগ্রেস জোট। দশ বছর পর হওয়া বিধানসভা ভোটে জিতে জম্মু-কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী হচ্ছে ওমর আবদুল্লা।
হরিয়ানায় ৪৮টি আসনে জিতে ক্ষমতায় ফিরছে বিজেপি, আর ৩৭টি আসনে জিতে হতাশ করল কংগ্রেস। হরিয়ানায় দুটি দলের মধ্যে ব্যবধান দাঁড়ায় ১১টি। তার মানে ৬টি আসনের ফলাফল এদিক ওদিকেই রাজ্যের মসনদ দখল হল। যেখানে রোহতাক সহ ৫টি আসনে কংগ্রেস প্রার্থীরা হেরেছেন ৬০০ ভোটের কমে। গেরুয়া শিবিরের চেয়ে হাত শিবির ১১টি আসন কম পেলেও বিজেপি আর কংগ্রেসের ভোটপ্রাপ্তির শতাংশের হিসেব প্রায় সমান। দুটি দলই ৩৯ শতাংশ ভোট পেল। ফারাক হয়ে গেল ছোট দলগুলির ভোটের সিংহভাগ গেল বিজেপির দখলে। নির্দল প্রার্থীরাও কংগ্রেসের ক্ষতি করল কিছু আসনে।
আরও পড়ুন- ২৯টি আসনে জিতলেও জম্মু-কাশ্মীরের বিজেপির ফলে গর্বিত মোদী, ভূ স্বর্গে হার স্বীকার নাড্ডার
আসুন এক নজরে দেখে নেওয়া যাক আজ বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল চুম্বকে উঠে আসা দশটি জিনিস--
১) হরিয়ানায় বিজেপি দেখালো ভোটে জিততে জানতে হয়: কৃষক আন্দোলন থেকে অগ্নিবীর নিয়ে বিক্ষোভ, ১০ বছর ধরে চলা সরকারের ওপর প্রতিষ্ঠান বিরোধী হাওয়া, সঙ্গে লোকসভায় খারাপ ফল, দলীয় কোন্দল- এবারের বিধানসভা ভোটের আগে হরিয়ানায় একেবারেই খারাপ জায়গায় ছিল পদ্ম শিবির। কিন্তু দলীয় কর্মীদের পরিশ্রম, নির্বাচনী কৌশল, ছোটদলগুলির সঙ্গে গোপনে রফা, ভোটের আগে মনোহর লাল খট্টারকে সরিয়ে মুখ্যমন্ত্রী পদে নায়াব সিং সাইনিকে আনার মত সব সিদ্ধন্ত নিয়ে বিজেপি দেখালো ভোট এমন একটা প্রক্রিয়া যেটা করে দেখাতে হয়। অনেকটা পিছিয়ে থাকলেও হতাশ হয়ে বিরোধীদের মাথাচড়া হওয়ার সুযোগ দেননি বিজেপি কর্মীরা। বরং ভোটের দিন বুথস্তরে গেরুয়া শিবিরের সংগঠন অসম্ভব ভাল করেছিল। তারই সুফল পেল বিজেপি। সেখানে কংগ্রেস ব্যস্ত থাকলে, ভোটে জিতলে কে মুখ্যমন্ত্রী হবে সেই নিয়ে। বিজেপি বিরোধী হাওয়া প্রবল থাকলেও ভোটে জেতার কোনও সুনির্দিষ্ট কৌশল ছিল না হাত শিবিরের।
২) ম্যান অফ দি ম্যাচ ফারুক আবদুল্লা: বয়স ৮৬ হয়েছে। শরীরটাও তেমন ভাল নেই। তবু অক্লান্ত পরিশ্রম করে দলকে ঐতিহাসিক জয় এনে দিলেন ন্যাশনল কনফারেন্সের প্রধান ফারুক আবদুল্লা। ২০১৯ সালে মোদী সরকার সংবিধানের ৩৭০ ধারা অবলুপ্তি করার পর জম্মু-কাশ্মীরের রাজনৈতিক নেতাদের গৃহবন্দি করেছিল। যাতে অশান্তি না ছড়ায়। গৃহবন্দি থেকে মুক্ত হওয়ার পর ফারুক আবদুল্লা প্রথমেই বলেছিলেন, আমার বয়স হয়েছে ঠিকই, কিন্তু রাজনীতি ছাড়়ব না, কাশ্মীরে বিজেপি হারিয়ে ছাড়ব। সেই কথাটাই রাখলেন এনসি প্রধান। বিজেপির সব কৌশল রুখে দিলেন ফারুক-এমর আবদুল্লা।
৩) আবার যেই কে সেই ফর্মে ফিরল কংগ্রেস: লোকসভা নির্বাচনে ভাল ফল করে দেশের রাজনীতিতে ফের প্রাসঙ্গিক হয়েছিল কংগ্রেস। কিন্তু হরিয়ানার হারে আবার 'যেই কে সেই' ফর্মে ফিরল হাত শিবির। জেতা ম্যাচ কীভাবে হারতে হয় সেটা দেখিয়ে দিল কংগ্রেস। অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসের খেসারত গুণতে হল হাত শিবিরকে। জম্মু-কাশ্মীরে এনসি-র সুবাদে ক্ষমতায় এলেও ফল খারাপ হল কংগ্রেসের।
৪) হরিয়ানায় কংগ্রেসের ১১ শতাংশ ভোট বাড়লেও কেন বিপর্যয়: ২০১৯ সালের থেকে এবার হরিয়ানায় বিধানসভায় ১১ শতাংশ ভোট বাড় কংগ্রেস। সেখানে বিজেপির বেড়েছে ৩ শতাংশ। দুটি দলই ৩৯ শতাংশ ভোট পেল। কিন্তু হুডা পরিবারের প্রতি অতিরিক্ত নির্ভরতা, প্রার্থী তালিকা নিয়ে দায়সারাভাব, আঞ্চলিক ছোটদলগুলিকে অবহেলা করা, দলের বিক্ষুব্ধ অংশকে পুরোপুরি গুরুত্বহীন করার মহাভুল করেই হার কংগ্রেস।
৫) এক্সিট পোল এবার কি এক্সিট করবে? লোকসভা নির্বাচনের পর আরও একবার এক্সিট পোলের ভরাডুবি হল। হরিয়ানা নিয়ে বেশীরভাগ এক্সিট পোলেই বলা হয়েছিল কংগ্রেস ৬০-৬৫টি আসন পেতে পারে। আর বিজেপি সেখানে ২০-২৫টি আসন পেতে পারে। বাস্তবে একেবারে ঘুরে গেল ফল। হরিয়ানার মত ছোট রাজ্যে যেভাবে এক্সিট পোল মুখথুবড়ে পড়ল তাতে আগামী দিনে এক্সিট পোলের আর কোনও বিশ্বাসযোগ্যতা থাকল কি না তা নিয়ে প্রশ্ন উঠল। তবে এটি ঠিক জম্মু-কাশ্মীরের ফলাফল কিন্তু মিলিয়ে দিয়েছে বেশীরভাগ সংস্থার এক্সিট পোল। অথচ হরিয়ানার চেয়ে ভূ-স্বর্গের এক্সিট পোলই কঠিন মনে করা হচ্ছিল।
৬) ভূ-স্বর্গে ধাক্কা খেল বিজেপি: গত পাঁচ বছরে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল থাকায় জম্মু-কাশ্মীরে অনেক বড় কিছু করার সুযোগ পেয়েছিল বিজেপি শিবির। কিন্তু মাত্র ২৯টি আসনে জিতে জম্মু-কাশ্মীরে হতাশ হতে হল নরেন্দ্র মোদীর দলকে।
৭) ভূ-স্বর্গে খাতা খুলল আপ, টানা পাঁচবার জিতলেন সিপিএম বিধায়ক: ভূ-স্বর্গের বিধানসভায় এই প্রথম আসন জিতল আম আদমি পার্টি। ডোডা বিধানসভা আসনে জয়ী হলেন আপ প্রার্থী মেহরাজ মালিক। বিজেপি প্রার্থী গজয় সিং রানাকে সাড়ে ৪ হাজার ভোটে হারান ৩৫ বছরের আপ প্রার্থী মেহরাজ। ভূ-স্বর্গে একটা আসনে জিতলেও হরিয়ানায় পুরোপুরি হতাশ করল আপ। আসন জেতা তো দূরের কথা বেশীরভাগ আসনেই কেজরির দলের প্রার্থীর জামানত জব্দ হল। ক মাস আগে লোকসভা ভোটে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট গড়ে লড়ে কুরুক্ষেত্রে আসনে লড়ে হারলেও ভাল ভোট পেয়েছিল আপ। কিন্তু দুই দিকে দুই আপ শাসিত রাজ্য থাকলেও হরিয়ানায় পরাস্ত হলেন কেজরিওয়াল।
কংগ্রেস, এনসি-র সঙ্গে জোট বেঁধে এবার জম্মু-কাশ্মীরে একটা আসনেই লড়েছিল সিপিআইএম। কুলগাম আসন থেকে জামাত-ই-ইসলামি প্রার্থীকে ৭ হাজার ৭০০ ভোটের ব্যবধানে হারালেন ভূ-স্বর্গে বামেদের মুখ এমওয়াই তারিগামি। টানা পাঁচবার এই আসন থেকে জিতে নজির গড়লেন এই সিপিআইএম নেতা।
৮) হাওয়া থাকলেই ভোটে জেতা যায় না: হরিয়ানা প্রমাণ করল হাওয়া থাকলেই ভোটে জেতা যায় না। বিজেপির বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠান বিরোধী হাওয়া ছিল সেটা ক মাস আগে হওয়া লোকসভা ভোটেই বোঝা গিয়েছিল। কিন্তু ছোট্ট রাজ্যে ভোটে জিততে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা আসল কথা নয়। আসল কথা হল, সুশৃঙ্খল,ঐকব্যদ্ধ লড়াই। কংগ্রেস এই হারে সেটা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। সাংসদ কুমারি শৈলেজার সঙ্গে হুডা পরিবারের বিবাদ শেষ অবধি কংগ্রেসের বড় ক্ষতি করে গেল। কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্ব একেবারেই সামলাতে পারলেন না দলীয় কোন্দল।
৯) মহারাষ্ট্র, ঝাড়খণ্ড নির্বাচনের আরও গুরুত্ব বাড়ল: বিজেপির হরিয়ানায় জয় আর জম্মু-কাশ্মীরে পরাজয় প্রমাণ করল ভারতীয় রাজনীতিতে সিংহাসনের লড়াই এখনও ৫০:৫০। লোকসভার পর হওয়া প্রথম বড় ভোটে স্কোরকার্ড এখন-এনডিএ ১, ইন্ডিয়া ১। এক্সিট পোলকে মিথ্যা প্রাণ করে হরিয়ানায় বিজেপির জয়টা মোদী-শাহর মনোবল বাড়াবে ঠিকই, কিন্তু সংবিধানের ৩৭০ ধারাকে নিয়ে লোকসভায় ব্যাপুক প্রচার করে এবার যেভাবে বিজেপিকে ভূ-স্বর্গে হারতে হল তাতে গেরুয়া শিবিরের চিন্তা বাড়ল। আগামী দু মাসের মধ্যে হতে চলা মহারাষ্ট্র আর ঝাড়খণ্ড বিধানসভা নির্বাচন আরও জমে গেল।
১০) মেহবুবা মুফতি, দুষ্মন্ত চৌতালারা কার্যত মুছে গেলেন: দশ বছর আগে ২৭টি আসনে জিতে একক বৃহত্তম দল হয়ে বিজেপির সাহায্য়ে সরকার গড়ে মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন পিডিপি নেত্রী মেহবুবা মুফতি। কিন্তু এবার মাত্র ৪টি আসনে জিতে ভূ-স্বর্গের রাজনীতি থেকে কার্যত মুছে গেল মুফতির পিডিপি। অন্যদিকে, ২০১৯ হরিয়ানা বিধানসভায় ১৪ শতাংশ ভোট পেয়ে বড় শক্তি হয়েছিল দুষন্ত চৌতালার জননায়ক জনতা পার্টি বা জেজেপি। পরে তিনি বিজেপি সরকারের উপমুখ্যমন্ত্রীও হন। সেখানে এবার তারা মাত্র ১ শতাংশ ভোট পেয়ে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল দুষন্ত চৌতালার জেজেপি। পিডিপি, জেজেপি-র মত রাজ্যদলগুলি কার্যত হারিয়ে গেল।